অবশেষে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ৫ মার্চ ১৯৫৩ তারিখে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলেন জোসেফ স্তালিন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার শীর্ষে ইস্পাতদৃঢ় এবং ভয়াবহ রকমের শীতল চরিত্রের মানুষটি। সমাপ্তি ঘটল ৭৪ বছরের ঘটনাবহুল এক বর্ণাঢ্য জীবনের। সাত দশকের জীবনে সোভিয়েত ইউনিয়নের একছত্র শাসন ক্ষমতার চাবিটি নিজের মুঠোয় রেখেছিলেন প্রায় আড়াই দশক।
একনায়কের আকস্মিক তিরোধানের পর, তার কার্যালয়ে নিজের টেবিলের ড্রয়ারে একটি পত্রিকার মধ্যে বেশ যত্ন করে রাখা তিনটি চিঠি পাওয়া যায়। প্রথমটি ছিল স্তালিনকে লেখা মার্শাল টিটোর একটি নোট। তাতে তিনি স্তালিনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘তাকে (টিটোকে) খুন করার জন্য একের পর এক গুপ্তঘাতক পাঠানো বন্ধ করতে। আর যদি স্তালিন তা না করেন, তবে তিনি (টিটো) খুব শিগগিরই মাত্র একজন আততায়ীকে মস্কো পাঠাবেন, যার লক্ষ্য হবে নির্ভুল।’ স্তালিন এরপর থেকে টিটোকে সমীহ করে চলতেন।
দ্বিতীয় চিঠিটি ছিল স্তালিনের এককালের সহযোদ্ধা, বন্ধু নিকোলাই বুখারিনের। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগার থেকে তিনি অনেকটাই অনুনয় করে স্তালিনকে লিখেছেন, ‘কোবা, কী কারণে আমার মৃত্যু অনিবার্য?’ সময়টা ছিল ১৯৩৭ সাল। সে সময়টা ছিল মহা আতঙ্কের, শুদ্ধি অভিযানের নাম স্তালিন তার বিরোধিতাকারীদের প্রায় সবাইকে বিভিন্ন অভিযোগে বা শুধুমাত্র সন্দেহের কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছিলেন। অসাধারণ প্রজ্ঞা আর ধী শক্তির অধিকারী, বিপ্লবী নেতা নিকোলাই বুখারিনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১৫ মার্চ ১৯৩৮ তারিখে। তখন তার বয়স ছিল ৪৯ বছর।
খুব ঘনিষ্ঠজনরাই শুধু স্তালিনকে ‘কোবা’ নামে সম্মোধন করতেন। রোমাঞ্চকর উপন্যাসের একটি চরিত্র- দুর্দান্ত, দুঃসাহসী জর্জিয়ার দস্যু দলপতি ‘কোবা’। বিপ্লবের উত্তাল দিনগুলোতে স্তালিন এ নামের আড়ালে বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যাংকের লকার ভাঙতেন, হানা দিতেন বিত্তশালী ভূস্বামীদের অর্থভাণ্ডারে।
তৃতীয় চিঠিটি ছিল স্তালিনকে লেখা খোদ লেলিনের চিঠি। চিঠিতে তারিখ লেখা ছিল ৫ মার্চ ১৯২২। রাশিয়ায় কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির লেনিন লিখেছেন, ‘স্তালিনকে তার (লেলিনের) স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়ার কাছে ক্ষমা চাইতে। কারণ স্তালিনের উদ্ধত আচরণে নাদেজদা মর্মাহত হয়েছেন, মনোকষ্টে ভুগছেন। চিঠির ভাষা মার্জিত হলেও তাতে তার উষ্মা স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রিয় কমরেড স্তালিন, আপনার জন্য দুটি পথ বাতলে দিচ্ছি, একটি হচ্ছে, আপনি আমার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। আর আপনি যদি তা করতে অপরাগ হন, সে ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটবে।’
লেলিনের প্রথম প্রস্তাবটি অনিচ্ছায় হলেও স্তালিন মেনে নিয়েছিলেন। নেতার স্ত্রীর কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন। তবে তার পরেও লেলিনের সঙ্গে তার দূরত্ব দূর করতে পারেননি এবং লেলিনের উত্তসূরিদের তালিকায় নাম ওঠাতে চরমভাবে ব্যর্থ হন। স্তালিন তাতে ভীষণ অপমানবোধ করেছিলেন এবং এমন দগদগে ক্ষতের কথা কখনোই ভুলে যাননি। রুশ ঐতিহাসিক লেভ লুরে মনে করেন স্তালিনই বিষ প্রয়োগে লেনিনকে হত্যা করেছেন।
উত্তসূরিদের তালিকায় নাম না উঠলেও ২১ জানুয়ারি ১৯২৪ তারিখে নেতার মৃত্যুর পর ক্ষমতার দৌড়ে জর্জিয়ার ‘কোবা’কে পিছনে ফেলা যায়নি। অন্যান্য জাঁদরেল প্রতিদ্বন্দ্বী কামেনেভ, জিনোভিয়েভকেই শুধু নয়, ক্যারিশম্যাটিক লিও ট্রটস্কিকে ডিঙিয়ে সুনিপুণ দক্ষতায় ক্ষমতার মসনদ নিজের দখলে নেন। ক্ষমতার আশপাশে যারাই নাক গলিয়েছেন, শুদ্ধি অভিযানের নাম করে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘প্রতিবিপ্লবী’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে তাদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। অগণিত দুর্ভাগা নাগরিককে সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার শ্রম শিবিরে নির্বাসিত করা হয়। রাশিয়ার অনেক জাতিগোষ্ঠীকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বহু মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়।
স্তালিন জন্মেছিলেন ১৮ ডিসেম্বর ১৮৭৮ তারিখে খুবই দরিদ্র পরিবারে জর্জিয়ার গোরিতে। ছোটবেলাটা তার খুব একটা ভালো কাটেনি। মদ্যপ পিতার নির্দয় প্রহার ছিল প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক। মা তাকে ধর্মীয় শিখায় দীক্ষিত করতে চাইলেও স্তালিন ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হন।
‘কোবা’ নামের মতোই ‘স্তালিন’ নামটিও তার একটি ছদ্মনাম। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল ইয়োসিফ (জোসেফ) ভিসারিওনোভিচ ঝুগাশভিলি। ১৯১৩ সালে দৈনিক পত্রিকা প্রাভদার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি সে পত্রিকায় স্তালিন ছদ্মনামে লিখতেন। লেনিনের নামের সঙ্গে অনেকটা ছন্দ মিলিয়ে নিজের নাম রাখেন স্তালিন অর্থাৎ ইস্পাত। আসলেই তিনি ছিলেন একজন দয়ামায়াহীন ইস্পাত কঠোর ব্যক্তি।
জোসেফ স্তালিন ক্ষমতায় ছিলেন ২৪ বছর (১৯২৯-১৯৫৩)। দীর্ঘতার এমন রেকর্ড এ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। আজকের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট স্তালিনের ভাবশিষ্য ভ্লাদিমির পুতিন এ বছর স্তালিনকে ছাড়িয়েছেন। তিনি একাধারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই ১৯৯৯ থেকে দোর্দণ্ড প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চে। বিগত ২৪ বছরে সামগ্রিক বিবেচনায় অর্থনীতি, রাজনীতিতে রাশিয়ার অর্জন ইতিবাচক। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে তার সদম্ভ উত্থান পশ্চিমারাও অস্বীকার করতে পারছে না। তবে মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে দমন-পীড়নে দক্ষতা দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ আছে।
পুতিন জন্মগ্রহণ করেন ৭ অক্টোবর ১৯৫২ তারিখে, স্তালিনের মৃত্যুর মাত্র ৭ মাস আগে। তিনি স্তালিনের মতাদর্শের প্রতি অনুরক্তি প্রকাশে কোনো রাখঢাক করেননি। বিরুদ্ধ পরাশক্তিগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছেন। ফলে বিশ্বজুড়ে অস্থির এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিজ বাস্তুভিটা ছেড়ে বিশাল এক জনগোষ্ঠী পরদেশে উদ্বাস্তু হয়েছে। অগণিত মানুষের রক্তে ভিজে যাচ্ছে পৃথিবীর এক অংশের মাটি। বহু দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে। বিপর্যস্ত অর্থনীতি আঘাত হানতে শুরু করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। পরাশক্তিগুলো অনেকটাই মুখোমুখি অনড় অবস্থান নিয়েছে। এই মুহূর্তে উত্তপ্ত পৃথিবী একটি পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকিতে ধুঁকছে। আর তাই কঠোর সমালোচনাকারীরা পুতিনের মধ্যে স্তালিনের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন এবং বলছেন, পুতিনের কাঁধে চেপেছে স্তালিনের ভূত।
লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী লেখক এবং গবেষক
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা