গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। প্রচারণার শেষ দিনে শ্লোগান ব্যানার ফেস্টুনে জমজমাট ছিল নির্বাচনী এলাকা। নানা প্রতিশ্রুতি আর ভোটের আবেদন নিয়ে দিনভর নগরবাসীর দরজায় কড়া নেড়েছেন প্রার্থীরা। ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে প্রার্থীরা নিয়েছেন প্রচারণার নানা কৌশল।
দেশের অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করলেও আনুষ্ঠানিকতায় কমতি রাখেনি নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বাড়িয়েছেন নির্বাচনের উত্তেজনার পারদ। নিজে নির্বাচনে অংশ নিতে না পেরে তার মা জায়েদা খাতুনকে করে তুলেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা বারবার তুলে বলেছেন, হামলা ও প্রচারণায় বাধা দেয়ার অভিযোগ। এখন অপেক্ষা ভোটের। আগামী বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণ হবে রাজধানী লাগোয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মোট ৩৩৪ জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে ৮ জন, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২৪৬ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৭৯ জন প্রার্থী। সাধারণ ওয়ার্ডে একজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ২৫মে নির্বাচনে লড়বেন ৩৩৩জন প্রার্থী।
৫৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৭ জন, মহিলা ভোটার ৫ লাখ ৮৬হাজার ৬৯৮ জন ও হিজড়া ভোটার আছে ১৮ জন। ৪৮০টি ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হবে। এরইমধ্যে ১০ হাজার ৯৭১ জন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। বুধবার সকাল থেকেই প্রতিটি কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠানো শুরু হবে।
কঠোর অবস্থানে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র ও আশপাশে সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বিজিবি। এছাড়াও ৪৮০ টি কেন্দ্রের মধ্যে ‘ঝূঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ৩৫১টি কেন্দ্রকে চিহিৃত করেছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, সাধারণ ভোটকেন্দ্রে একজন অস্ত্রসহ এসআই/এএসআই, ৩ জন কনস্টেবল, অস্ত্রসহ ১ জন আনসার (পিসি), অস্ত্রসহ ১ জন (এপিসি), ১০ জন আনসার সদস্যসহ মোট ১৬জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী জনবল থাকবে। পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ান আনসারের সমন্বয়ে প্রতি সাধারণ ওয়ার্ডে ১টি করে মোবাইল ফোর্স, ৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স, প্রতি থানায় একটি করে রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। প্রতি ২ ওয়ার্ডে একটি করে র্যাবের দল ও ৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১ প্লাটুন করে বিজিবি থাকবে। এছাড়াও কেন্দ্র অনুযায়ী থাকবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভ্রাম্যমাণ আদালত টিম।
জমজমাট লড়াইয়ের আভাস
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এ নির্বাচনে মেয়র পদে লড়াইয়ের আভাস মিলছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারেন। মেয়র পদে ৮ জন প্রার্থী থাকলেও মূল লড়াইয়ে থাকবেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান, স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন, বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে সরকার শাহনুর ইসলাম রনি। তবে ইসলামী আন্দোলনও উল্লেখযোগ্য একটি ভোট পেয়ে আলোচনায় আসতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে: আজমত
মঙ্গলবার সকালে নগরীর টঙ্গী এলাকার বাসায় নেতাকর্মীদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা। প্রচারণার শেষ দিনে তিনি কোথাও গণসংযোগে বের হননি। আগামী ২৫ মে নৌকার পক্ষে রায় দিতে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে গাজীপুরে ভোট হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। চ্যালেঞ্জ থাকলেও নৌকার জয়ের ব্যপারে শতভাগ আশা প্রকাশ করে আজমত উল্লা বলেন, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো প্রার্থীর প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ হচ্ছে না, হবেও না।
আজমত উল্লা বলেন, প্রচারনাকালে আমি নগরবাসীর ব্যাপক সমর্থন পেয়েছি, যেখানেই গিয়েছি নৌকার পক্ষে গণজোয়ার দেখতে পেয়েছি। গাজীপুরে ভোট উৎসব হচ্ছে, একটি দল অংশ না নিলেও উৎসবে কোনো ঘাটতি হয়নি।
বিকেলে তিনি গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে যোগ দেন। সকাল থেকেই আজমত উল্লা খানের পক্ষে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন নেতা, সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটসহ গাজীপুর ও এর আশপাশ জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা গণসংযোগ করেন।
নগরবাসীকে সকালেই ভোটকেন্দ্রে আসার আহবান জায়েদার
‘যত বাধা আসুক, যতই হুমকি আসুক’ ভোটের দিন সকাল সকাল ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। প্রচারনার শেষ দিন বিকেল ৪টায় ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে সাথে নিয়ে তিনি প্রচারণায় বের হন। পরে তিনি নগরের ছয়দানা, মালেকের বাড়ী, সালনা, চান্দনাসহ গাজীপুর শহরে গণসংযোগ করেন।
তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ভোটের দিন ভোটারদের হাতে থাকবে সকল ক্ষমতা। তাই ভোটারদের সকল ধরনের অন্যায়ের জবাব ভোটের মাধ্যমে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়াও ভোট যাতে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য কেন্দ্র পাহারা দেয়ারও আহ্বান জানান জায়েদা খাতুন।
ইসলামী আন্দোলনের গনমিছিল
প্রচারণার শেষ দিন নগরের ৫৭টি ওয়ার্ডে একযোগে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করেই গণমিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা মিছিল করে। এর আগে দলের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান দুপুরে টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে বিকেলে গাজীপুর সদর মেট্রো থানার বিভিন্ন এলাকায় ভোট চান তিনি।
গণসংযোগকালে তিনি বলেন, তারা অন্যান্য প্রার্থীদের চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী প্রচার চালিয়ে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শেষ করেছেন। প্রতিটি ভোটারের কাছে তারা ভোটের দাওয়াত দিয়েছেন। প্রভাবমুক্ত ও সুষ্ঠু ভোট হলে তারাও জয়ের বিষয়ে আশাবাদী।
এই প্রার্থী বলেন, আমরা বিকল্প শক্তি হিসেবে ভোটারদের বোঝাতে মাঠে কাজ করেছি। সিটি গঠনের পর কোনো নির্বাচিত মেয়র যেমন তার পূর্ন মেয়াদ শেষ করতে পারেনি, তেমনি নগরেরও উন্নয়ন হয়নি। আমাদের আশা ভোটারই সব শক্তির নিয়ামত হিসেবে আমাদের উপর আস্থা রাখবে।
বিএনপির ভোটে কড়া নজর রনির
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহ নুর ইসলাম রনি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। প্রথম থেকেই তার নজর বিএনপির ভোটের দিকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নির্বাচন না করায় ও প্রতি ওয়ার্ডে তাদের কাউন্সিলর প্রার্থী না থাকায় তৃনমূলে কর্মী সমর্থকরা ভোটে অংশ নেবেন কি-না তা নিশ্চিত না হওয়ায় তার কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। দলের ভোট না পেলে তাকে হতাশ হয়েই ভোটের মাঠ থেকে ফিরতে হবে। প্রচারণার শেষ দিন তিনি টঙ্গী এলাকায় গণসংযোগে ব্যস্ত সময় কাটান।
তিনি বলেন, বিএনপি দলীয় ভাবে প্রার্থী না দেয়ায় দলটির কর্মী সমর্থকরা তাকে বেছে নেবে। এছাড়াও সরকার বিরোধী ভোটও তিনি পাবেন।
ভোটের প্রচারে খুশি জাতীয় পার্টির নিয়াজ
জাতীয় পার্টির হয়ে মেয়র পদে ভোটের জন্য নগর চষে বেড়িয়েছেন সাবেক সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন। প্রচারণার শেষদিন তার মেয়ে ইশরাত জাহান সুপ্তিকে নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নগরীর গাছা, বোর্ডবাজার ও মেট্রো সদর থানা এলাকায় গণসংযোগ চালান।
গনসংযোগকালে তিনি বলেন, তিনি গাজীপুরের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। অনেক লোককে চাকরি দিয়েছেন, শিক্ষাখাতে উন্নয়ন করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি জনগনের ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। প্রচারণার শেষ দিন নগরবাসীর কাছে নিজের দেয়া ইশতেহার বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট চান।
প্রচারের শেষ দিনে বৃষ্টি বাধা
প্রচারণার শেষ দিন সকল প্রার্থীর বিকেলে গণসংযোগের প্রস্ততি থাকলেও তাতে ছন্দপতন ঘটায় ঝড় বৃষ্টি। পরে অনেকেই ফিরে গিয়ে ঘরোয়া বৈঠকে যোগ দেন।
তরুণদের ভোটে নজর সবার
গাজীপুরে গত নির্বাচনের সময় ভোটার ছিল ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০৪ জন, এবার ৪১ হাজার ২৭২জন বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। গতবারের চেয়ে বাড়তি এই ভোটারের বড় অংশই তরুণ। তাই নির্বাচনে তরুণদের ভোটও একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
গাজীপুর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, মহানগরের হালনাগাদকৃত ভোটারের সিংহভাগই তরুণ। তারা রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ ভোটারের চেয়েও বেশি সচেতন। অতীতে যারা দুর্নীতি করেছেন তারা তাকে ভোট দেবে না, একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্ব বিকাশ হোক সেটাও প্রত্যাশা করেন।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা