স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব, পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা, হাসপাতালগুলোতে ভোগান্তি এবং অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে দেশে এখনো ৫০ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় বাড়িতে। এ মায়েরা গর্ভধারণকালে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পান না। ফলে আশানুরূপ হারে কমছে না মা ও নবজাতক মৃত্যুর হার।
অথচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শতভাগ সন্তান প্রসব হাসপাতালে না হলে মাতৃমৃত্যু কমবে না। এই বাস্তবতায় আজ ২৮ মে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কোনো নারীর প্রাণহানি ঘটলে তা মাতৃমৃত্যু বলে বিবেচিত হয়। গর্ভধারণজনিত জটিলতার কারণে, প্রসবকালে এবং প্রসব-পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে প্রাণহানি ঘটলে তা মাতৃমৃত্যু। এক লাখ গর্ভধারণে নারী মৃত্যুর সংখ্যাকে মাতৃমৃত্যুর হার হিসেবে ধরা হয়।
একজন নারীকে সন্তান গর্ভধারণের আগে থেকে প্রসব পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হয়। এ সময় জটিলতা তৈরির শঙ্কা বেশি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই মাতৃত্বকালীন সেবা আটবার দেয়ার পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশে সেটি চারবার করা হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক নারী এই চারবারের সেবাও গ্রহণ করছেন না। যার কারণে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এর চিকিৎসকদের মতে, নারীদের জীবনের দাম, মতামতের দাম কম। শুধু কম নয়, নারীদের মতামতের গুরুত্ব নেই, নেয়াই হয় না মতামত। যার কারণে যখন তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন সেটা অনেক বেশি দেরি হয়ে যায়।
এদিকে, দেশে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, দেশে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছে। প্রায় ১০ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে এই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। আর তার বেশির ভাগই হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। এ জন্য বেসরকারি হাসপাতালের ওপর নজরদারি বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রতি ১০০ গর্ভধারণে ১০ থেকে ১৫ জন মায়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং প্রসবকালে জটিলতা হতে পারে। আর এ সময় মা ও সন্তানের জীবন রক্ষায় প্রসবের সময় অস্ত্রোপচার করতে হয়। তখন এটি জীবনরক্ষার জন্যই করা হয়। কিন্তু সেটা যদি ১৫ শতাংশের বেশি হয় তাহলে তা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৩৬ লাখ শিশুর জন্ম হয়, তার মধ্যে ১৬ লাখের মতো শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে আবার ১০ লাখ ৮০ হাজার শিশুর জন্ম অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে হচ্ছে। আর এই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের বেশিই হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যত শিশুর জন্ম হয় তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাকিদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে হচ্ছে ১৪ শতাংশ আর ২ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে। জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালেই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে কমপক্ষে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। ফলে হাসপাতালগুলোতে সন্তান জন্মদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন মায়েরা। আর হাসপাতালে যান না বলে তাদের গর্ভকালীন চেকআপও হয় না ঠিকমতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম হচ্ছে একজন মাকে সন্তান প্রসবের আগে চারবার নিয়মমাফিক চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রসবপূর্ব সেবার প্রথম ধাপে যত মা সেবা নেন, তার তুলনায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে সেবা নেয়ার হার অনেক কমে আসে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, ২০২২ সালে উপজেলা থেকে নগর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের তুলনায় চতুর্থবার সেবা নেয়ার হার ছিল ৬৪ শতাংশ কম। আর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জানাচ্ছে, ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের তুলনায় চতুর্থবার পর্যন্ত নারীদের সেবা নেয়ার হার ছিল ৬০ শতাংশেরও কম।
ওজিএসবি সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম বলেন, সন্তান ধারণের পর থেকে নিয়মিতভাবে চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার নিয়ম হলেও সেটা পালন করা হচ্ছে না। যদি এটা হয়, তাহলে মা ও শিশু প্রসবকালীন জটিলতা থেকে মুক্ত হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (মাতৃস্বাস্থ্য) আজিজুল আলিম জানান, সমস্যা না হলে দেশে নারীদের হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা যেকোনো রোগেই কম। আর সন্তান ধারণ করলে তাকে আরও পরিবারের অনুমতির ওপর নির্ভর করতে হয়। নারীরা এখনো মনে করেন, শুধু সন্তান জন্মদানের সময় হাসপাতালে গেলেই হবে।
চারবার সেবা নেয়ার কথা বলা হলেও তার গুরুত্ব কম। তবে এখন সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তা হলে, সন্তান প্রসবের পরই মাতৃমৃত্যু কমে আসবে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা