আপডেট : ১ জুন, ২০২৩ ১৯:১৫
‘একজন বিক্রয়কর্মীর মৃত্যু’
বিনোদন প্রতিবেদক

‘একজন বিক্রয়কর্মীর মৃত্যু’

‘ডেথ অব অ্যা সেলসম্যান’ মার্কিন নাট্যকার আর্থার মিলারের এক বিখ্যাত সৃষ্টি। উইলি লোম্যান নামের একজন বিক্রয়কর্মীর মৃত্যুর ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত এই কাহিনি আধুনিক সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন পাঠ্য, তেমনি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের রঙ্গমঞ্চে প্রদর্শিত হচ্ছে গত কয়েক দশক ধরে। ঢাকার মঞ্চে নতুন করে এটি হাজির করল থিয়েটারিয়ান নামের একটি নবীন নাট্যদল। এটি তাদের প্রথম প্রযোজনা। তারই দ্বাদশ প্রদর্শনী হলো সোমবার সন্ধ্যায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে। সেটি উপভোগের অভিজ্ঞতা ছিল মনোমুগ্ধকর।

ফতেহ্ লোহানীর অনুবাদ এবং আশিকুর রহমান লিয়নের নির্দেশনায় নাটকটির মঞ্চসজ্জা, আলোক প্রক্ষেপণ, শব্দ নিয়ন্ত্রণ, রূপসজ্জা, পরিচ্ছদ, নাট্যরূপ ও অভিনয়—সবই আকর্ষণীয় ছিল। এমন একটা চমৎকার মঞ্চনাটকের আরও বেশি প্রচার ও প্রসার প্রয়োজন। সব মিলিয়ে নাটকটি যেকোনো পাঠক বা দর্শকের জীবনবোধকে আন্দোলিত করার সামর্থ্য রাখে।

পুঁজিবাদী সমাজে সাধারণ মানুষের নিরন্তর লড়াই, আপ্রাণ প্রয়াস এবং কখনো কখনো মৃত্যুর মতো বেদনাদায়ক বাস্তবতার কাছে পরাজয় ‘ডেথ অব অ্যা সেলসম্যান’ নাটকের মূল নির্যাস। পুঁজিবাদের বেড়াজালে যে সমাজের জন্ম, সেখানে জনগণের অস্তিত্ত্বের মাপকাঠি নিরূপণ হয় অর্থের পাল্লায়। আর এমন আত্মকেন্দ্রিক সমাজে বিত্তের কাছে ব্যক্তির সত্ত্বা প্রতিনিয়ত পরাস্ত হয়। পরিণামে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ব্যক্তির জীবন সংগ্রাম, স্মৃতি, অনুশোচনা, পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ও টানাপোড়েন, নারী-পুরুষের জটিল রসায়ন প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে। পুঁজিবাদী সমাজকে এখানে দেখা যায় ক্ষুধার্ত রাক্ষসের রূপে। তাই বাংলাদেশের সমকালীন নাগরিক জীবন বাস্তবতায় এই নাট্যপ্রযোজনা হয়ে ওঠে খুব প্রাসঙ্গিক।

চেতনাপ্রবাহ রীতিতে লেখা ‘ডেথ অব অ্যা সেলসম্যান’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র উইলি লোম্যানের অস্থিরতা, স্ববিরোধিতা, আশাবাদ আর নৈরাশ্যের দোলাচল, ফ্ল্যাশব্যাক, সংসার-সম্পর্ক, প্রেম—ইত্যাদি প্রকাশে বাস্তবমুখী অভিনয়পদ্ধতির মনস্তাত্ত্বিক নির্যাসের সঙ্গে যুৎসই অনুসঙ্গ হয়েছে অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশ। পুঁজিবাদী সমাজে আমরা কেমন করে বেঁচে থাকি আর প্রতিনিয়ত মারা যাই—সেই প্রশ্ন নাটকটির পরতে পরতে উত্থাপিত হয়েছে। স্মৃতি, স্বপ্ন, দ্বন্দ্ব এবং তর্কের এক মিশ্র ছবি এই নাটক, যা উইলি লোম্যানের জীবনের শেষ দিনটির বয়ান করে।

তিনি একজন ব্যর্থ বিক্রয়কর্মী বা সেলসম্যান, যিনি ‘অ্যামেরিকান ড্রিম’ সম্পর্কে ভুল ধারনা নিয়ে জীবনটা পার করেছিলেন। তার মৃত্যু তাই পুঁজিবাদী বিশ্বে মধ্যবিত্তের মৃত্যুর খুব সাধারণ ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। ভোগবাদী পৃথিবীতে সবাই পণ্য হিসেবে গণ্য। বড় বড় কোম্পানি তার শ্রমিকদের রক্ত-মাংস থেকে শুরু করে মন ও মনন পর্যন্ত চুষে খায়, তারপর পরিত্যক্ত ছোবড়া হিসেবে সেকেলে শ্রমিকদের ছুড়ে ফেলে নতুন শ্রমবাজার ও শ্রমশক্তির দিকে ঝোঁকে। এটিই যেন বর্তমান বিশ্ব-অর্থনীতির পুঁজি তত্ত্বের লুকোনো রহস্য। আর এই শোষণমূলক অর্থনীতির পরতে পরতে লুকেয়ে থাকে লাখো মানুষ ও তাদের পরিবারের গল্প, নানা রঙের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ব্যর্থতার কাহিনী। এরকমই এক স্বপ্নভঙ্গের গল্প নিয়ে তৈরি আর্থার মিলারের ‘ডেথ অব অ্যা সেলসম্যান’।

উইলি লোম্যানের চরিত্রে তৌহিদ বিপ্লব ও তার স্ত্রী লিন্ডার ভূমিকায় পলি চৌধুরী অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তাদের দু-জনেই বয়সে তরুণ। কিন্তু উইলি ও লিন্ডার বার্ধক্য মঞ্চে আরও বাস্তবসম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলতে তাদের আরও করণীয় আছে বলে মনে হয়। এই দীর্ঘ নাটকে উইলি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মঞ্চে ছিলেন কখনো বিক্রয়কর্মী, কখনো, বাবা, কখনো স্বামী, কখনো বন্ধুর ভূমিকায়। কণ্ঠের কাজে তৌহিদ কিছুটা বৈচিত্র্য আনার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন। বিফ লোম্যানের চরিত্রে মো. মাইনুল ইসলাম তাওহীদ বেশ প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন। মঞ্চে তার উপস্থিতিও ছিল বেশ দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য চরিত্রে আহমেদ সুজন, রামকান্ত মণ্ডল শ্রীকান্ত, নাজমুল নাঈম, আব্দুল হাই, মাধবীলতা, রিগ্যান সোহাগ রত্ন, আব্দুর রহমান সোহাগ, সায়েদুর রহমান নয়ন, তৌহিদা সিকদার, ফজলে হাসান রাব্বী, ফারাবী জামান শেহজাদী সাবলীল অভিনয় করেছেন।

চার্লি এবং বেন নামের দুটি চরিত্রের আবির্ভাব এই নাটকের বিভিন্ন দৃশ্যকে সমৃদ্ধ ও গতিময় করেছে। চার্লির ভূমিকায় আমিরুল মামুন চমৎকার কাজ করেছেন। একাধিক দৃশ্যে তিনি হাসি-কান্নাকে এমনভাবে একাকার করে দেন, যা এক গভীর জীবনদর্শনের অসাধারণ শৈল্পিক উপস্থাপন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।

আগ্রহী দর্শকদের জন্য তথ্য দিয়ে রাখা, মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘ডেথ অব অ্যা সেলসম্যান’ নাটকের পরবর্তী প্রদর্শনী হবে আগামী ১৭ জুন ২০২৩ সন্ধ্যা ৭টায়।