ছুটির দিন মানে ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে ভ্রমণের দিন। ঠিক তেমনি এক ছুটির দিনে আমরা ৫ বন্ধু মিলে চলে গেলাম চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অতি পরিচিত একটি ঝরনাতে। ঝরনার নাম নাপিত্তাছড়া ঝরনা। নাম শুনলে হয়তো একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে এই অদ্ভুত নামের ঝরনাটিতে পাবেন চমৎকার ট্রাকিং আর প্রকৃতি দেখার সুযোগ। নাপিত্তাছড়া ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম বন্ধুরা মিলে। এই ভ্রমণে সঙ্গী হতে বোয়ালখালী থেকে দুই বন্ধু এবং একজন বড় ভাই এসেছেন। আর চট্টগ্রামে আমরা দুই বন্ধু তো আছিই। সর্বমোট ৫ জনের এই গ্রুপটি সকাল ৮টায় চট্টগ্রামের এ কে খান থেকে রওনা দিলাম মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারি হাটের উদ্দেশে। চট্টগ্রাম নগরীর এ কে খান থেকে ঢাকা-কুমিল্লাগামী বাসে উঠে নয়দুয়ারি বাজার বা হাট বললেই নামিয়ে দেবে। জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা করে নেবে।
যা-ই হোক বাসে উঠলাম, প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট স্থানে। অর্থাৎ নয়দুয়ারি হাটে। গাড়ি থেকে নেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে ঝরনা দেখতে যাওয়ার রাস্তা কোনটি। চাইলে ওই গ্রাম থেকে একজন গাইড নিয়ে নিতে পারেন, ৪০০-৫০০ টাকার মতো নেবে ৪-৫ ঘণ্টার জন্য। আমরাও একজন গাইড নিলাম। ভদ্রলোকের নাম আব্দুল করিম। আমরা করিম ভাই বলেই ডাকছি তাকে।
এরপর পাহাড়ি অরণ্যে ঝিরিপথ বরাবর চলা শুরু করলাম করিম ভাইয়ের পেছন পেছন। করিম ভাই বলেন, এখানে মোট ৪টি ঝরনা আছে- টিপরাখুম ঝরনা, কুপিটাকুম ঝরনা, মিঠাছড়ি ঝরনা ও বান্দরখুম ঝরনা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ এবং প্রচণ্ড গরম আমাদের কিছুটা ক্লান্ত করেছে। তবে যত যাচ্ছি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাথর আর পানি তো আছেই। সঙ্গে আছে বিশাল বিশাল পাহাড়ের খাদ। ভয়ংকর কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। দুই পাশে পাহাড় আর মাঝখানে সরু রাস্তা। রাস্তা বলতে এটা সহজ রাস্তা নয়। কখনো বড় বড় পাথর পাড়ি দিতে হবে, কখনো ছোট ছোট পানির গর্ত পাড়ি দিতে হবে, আবার কখনো উঠতে হবে পাহাড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে এই পথে যাওয়ার সময়। তবে ঝরনায় যাওয়ার এই রাস্তাটির প্রতিটি অংশই অদ্ভুত সুন্দর। এভাবেই আমাদের গাইড করিম ভাই আমাদের নিয়ে চলে এলেন ঝরনার কাছে। ঝরনা চারটি বেশি দূরে নয়। আমরা প্রথম ঝরনাটির সামনে চলে এলাম। তবে এই টিপরাখুম ঝরনার পানি ততটা স্বচ্ছ নয়। কিন্তু বাকি ঝরনাগুলোর চেয়ে এই ঝরনাটি সবার আগে। তাই অনেকে ক্লান্ত হয়ে এখান থেকেই ফিরে যায়। এর প্রায় ১০-২০ মিনিট যাওয়ার পর দ্বিতীয় ঝরনা কুপিকাটাকুম পেয়ে যাবেন। অনেক সুন্দর একটি ঝরনা। ঝরনায় পানির পরিমাণও ভালো। ঝরনাটির সামনের পানির অংশটি কিছুটা গভীর। তাই একেবারে ঝরনার সামনে যেতে হলে আপনাকে সাঁতার কেটে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ঝরনার পানি বেশ ঠাণ্ডা। সূর্যের এই তাপের মাঝেও একটুখানি প্রশান্তি পাওয়া যায় এই ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলে। পানিগুলো পানও করা যায়।
যা-ই হোক, ঝরনার পানি পান করলাম, ছবি তুললাম, নাশতা করলাম এবং হালকা বিশ্রাম নিলাম। এরপর তৃতীয় ঝরনা মিঠাছড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। মিঠাছড়ি ঝরনায় যাওয়ার সময় ছোট একটি পাহাড়ের প্রায় খাড়া একটি ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। এটা বেশ ভয়ংকর। তাই যাদের ট্রাকিং করার অভিজ্ঞতা কম, তাদের এ সময় কিছুটা সতর্ক থাকতে হয়। ঝরনাটি বেশ কাছেই। ২০ মিনিটের মধ্যেই মিঠাছড়ি ঝরনায় পৌঁছে যাবেন। ঝরনাটির উচ্চতা বেশ। ওপর থেকে পানি পড়ার সময় অর্ধেকটা অংশ পার হওয়ার পর দুই ভাগ হয়ে দুই দিকে পানি পড়ে। নিজের চোখে না দেখলে দৃশ্যটি সত্যি বলে বোঝানোর মতো নয়। বিশেষ করে বর্ষার সময় এই ঝরনাটি খুব সুন্দর দেখায়।
মিঠাছড়ি ঝরনায় কিছুক্ষণ থাকার পর সর্বশেষ ঝরনা বান্দরকুম বা বান্দরিছড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু কললাম। প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট ঝিরি পথ বরাবর হাঁটার পর ঝরনাটি পেয়ে যাই। এই ঝরনাটিও বেশ সুন্দর। বাকি তিনটি ঝরনার চেয়ে এই ঝরনাটির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। ঝরনায় যাওয়ার ঝিরি পথটা অনেক সুন্দর। তেমন কোনো ভয়ংকর রাস্তাও ছিল না। তবে এই ঝরনাগুলো দেখতে বর্ষার সময় আসাটাই সবচেয়ে ভালো সময়, তাহলে ঝরনার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
দীর্ঘ সময় ঝরনার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। এবার ফেরার পালা। রওনা দিলাম গাইড করিম ভাইয়ের পেছন পেছন। ৪-৫ ঘণ্টা বললেও আরও বেশি সময় লেগেছে আমাদের। প্রায় সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আর বেশি সময় থাকা যাবে না।
গাইড নেয়ার সুবিধাটা উপলব্ধি করলাম আমরা শেষ সময়ে। যেদিক দিয়ে এসেছিলাম, সেদিক দিয়ে সবাই যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি, তখন ভিন্ন পথ দিয়ে যাচ্ছি। এই ভিন্ন পথে যাওয়ার কারণটা হচ্ছে সহজ রাস্তা। আর এই সহজ রাস্তাটা গাইড থাকার কারণেই চেনা। ঝরনার পাশেই পাহাড়ে বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। এরপর অল্প হেঁটেই পাহাড় দিয়ে শুধু নামলেই চলবে। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা নেমে গেলাম। তখনই বুঝলাম গাইড কেন প্রয়োজন। গাইড না থাকলে এমন সহজ পথ আছে কেউ জানত না। তবে পাহাড় বেয়ে উঠা যেমন কষ্ট, নামাও তেমন কষ্ট। এটা নাপিত্তাছড়া ঝরনা ভ্রমণে না এলে বুঝতে পারতাম না।
পুরো ভ্রমণের সার্থকতা খুঁজতে চাইলে প্রথমেই বলতে হবে ট্রাকিংয়ের কথা। বড় বড় পাথর আর পাহাড়ের গহিনে যাওয়াটা সহজ বিষয় না। এ ছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার স্বাদ তো পাবেনই। তবে ঝরনার কাছাকাছি চলে এলে দূর হয়ে যাবে আপনার সব ক্লান্তি। নিজের চোখে জলপ্রপাত দেখার এই অপূর্ব অনুভূতি একমাত্র যিনি দেখেন তিনিই জানেন।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে উঠে নয়দুয়ারি বাজারে নেমে যেতে হবে। ট্রেনে করে এলেও সীতাকুণ্ডে নেমে নয়দুয়ারি বাজার আসা যায়। চট্টগ্রামের এ কে খান থেকে নয়াদুয়ারি বাজার আসতে পারবেন বাসযোগে।
কোথায় থাকবেন?
এই ভ্রমণ এক দিনের। তাই থাকার দরকার পড়বে না, তবুও নিতান্তই রাতে থাকতে চাইলে মিরসরাই বা সীতাকুণ্ডে হোটেল পাবেন। ভালো হোটেলে থাকতে চাইলে চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে।
খাবেন কোথায়?
ট্রেইলে যাওয়ার পথে একটা ছোট হোটেল আছে, সেখানে যাওয়ার আগে কী খাবেন তার অর্ডার দিয়ে যেতে হবে। তাহলে রান্না করে রাখবে, ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া করতে পারবেন। এ ছাড়া ভালো মানের খাবার খেতে চাইলে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে ভালো মানের রেস্তরাঁ রয়েছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা