আপডেট : ৮ জুন, ২০২৩ ১২:৫২
রংপুরে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার না হওয়ায় আতঙ্ক
মীর আনোয়ার আলী, রংপুর

রংপুরে শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার না হওয়ায় আতঙ্ক

রংপুরের শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খালের উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে আছে। সংস্কারে নেই কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি। অথচ এই খালটি সংস্কারের অভাবে তীব্র জলাবদ্ধতায় ভুগছে রংপুরবাসী। ২০২০ ও ২০২১ সালে ভারী বৃষ্টিপাত হলে টের পাওয়া যায় এর প্রভাব। এবারও বর্ষার আগে শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কার না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন নগরবাসী।

রংপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৮৯০ সালে তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান ও ডিমলার রাজা জানকিবল্লভ সেন তার মা শ্যামাসুন্দরীর স্মরণে এ খাল খনন করেছিলেন। খালটি রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে ১৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এলাকাভেদে এর প্রস্থ ২৩ থেকে ৯০ ফুট। খালটি উত্তর-পশ্চিমে সিওবাজার কেল্লাবন্দ ঘাঘট নদী থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকা দিয়ে মাহিগঞ্জ সাতমাথা রেলগেট এলাকায় কেডি ক্যানেল স্পর্শ করে খোকসার ঘাঘট নদীতে মিশেছে।

রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) ও বিভাগ হওয়ার পর থেকে নগরীতে জনসংখ্যা বেড়েছে। শ্যামাসুন্দরী খাল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক ভবন। এসব জায়গা থেকে আসা প্রতিদিনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী খালে। এতে খাল ভরাট হয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পানির প্রবাহ না থাকায় দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি মশা-মাছি তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, শ্যামাসুন্দরী খাল সংস্কার, খালের ওপর সেতু নির্মাণ ও খাল খননকাজের জন্য ২০১৪ সালে ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রথম দফায় খাল সংস্কারের কাজ হয়। সে সময় খালের দুই পাড়ে সিমেন্টের তৈরি খুঁটি বসানো হয়, পাশাপাশি খাল খনন ও খালের ওপর তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়। তবে তাতে খুব একটা কাজ হয়নি।

পরে শ্যামাসুন্দরীর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিসহ বিশেষজ্ঞ ও সব শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনা সভা হয়। শ্যামাসুন্দরীকে পুনরুজ্জীবিত করতে তিনটি ধাপে পরিকল্পনা নেয়া হয়। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সীমানা নির্ধারণসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয়। কিন্তু এরপর আর কার্যক্রম এগোয়নি। তার ফল ভোগ করতে হয় পরের দুবছর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর ১১ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রংপুর নগরীর প্রধান সড়ক, পাড়া-মহল্লার অলি-গলিসহ বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মালামাল, খাদ্যশস্যসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে স্থানীয়রা গবাদি পশুসহ আশ্রয় নেন নগরীর স্কুলগুলোতে। এর পরও রংপুর সিটি করপোরেশনসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা শ্যামাসুন্দরী খাল নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি।

পরের বছর ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ২৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় রংপুরে। এবারেও পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ না থাকায় জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে নগরী। পরে ২০২১ সালের শেষের দিকে শ্যামাসুন্দরী নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বিকন ডিজাইন স্টুডিও নামের একটি পরামর্শ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় রংপুর সিটি করপোরেশন। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠান ধীরগতিতে কাজ করায় তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারিনি।

নগরীর উত্তর মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা হাসান আলী বলেন, গত দুই বর্ষায় ঘরবাড়িতে হাঁটুসমান পানি উঠেছিল। এবারও সেই শঙ্কা রয়েছে। যত দ্রুতসম্ভব খালটি সংস্কার করা হোক।

রংপুর নগরীর সাতমাথার বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমরা বর্ষার আগেই শ্যামাসুন্দরী খালের সংস্কার চাই। তিন বছর ধরে সংস্কারের কথা শুনে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। বর্ষায় নগরবাসীর দুঃখে পরিণত হয়েছে এ খাল। পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনার কারণে দুর্গন্ধ আর মশার উৎপাত চরমে উঠেছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, শ্যামাসুন্দরী খালের বর্তমান এমন অবস্থা যে ভারী বর্ষণ হলে গোটা রংপুর নগরী পানিতে ডুবে যাবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ৩০ বছর আগে কীভাবে পানি প্রবাহিত হতো, ঘাঘট থেকে শ্যামাসুন্দরীতে কেন পানি প্রবাহিত হচ্ছে না, কোথায় কোথায় পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, এসব আমাদের চিহ্নিত করতে হবে।

জানতে চাইলে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত পাঁচ বছরে খালের ১৭০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার মাত্র ছয় মাস হয়েছে। শ্যামাসুন্দরীর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।