দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা নিয়ে আগের অবস্থানেই রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতা বিভিন্ন সময়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন। অন্য নেতারাও বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপে আগ্রহ নেই ক্ষমতাসীন দলের। তবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফুলে ওঠা সংলাপের ফানুস ২৪ ঘণ্টা পেরুনোর আগেই আবার চুপসে গেছে।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করে দেয়া বক্তব্য থেকে এক দিন পরই সরে এলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। আগের দিনের দেয়া বক্তব্য বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনার কথা বললেও পরদিন বললেন কাউকে আলোচনার জন্য আহ্বান করা হয়নি।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে দলে বা ১৪-দলীয় জোটে কোনো আলোচনা হয়নি, কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমির হোসেন আমু যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সমাধান করার মতো সংকট স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি।
১৪-দলীয় জোটের নেতারা বলছেন, আমির হোসেন আমু কেন এই কথা বললেন তা তারা জানেন না। একই সঙ্গে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন জোট নেতা শেখ হাসিনা। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের অবকাশ নেই বলছেন কোনো কোনো নেতা। আবার কারও মত, নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সময় হয়নি।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ১৪-দলীয় জোটের সমাবেশে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই। সু্ষ্ঠু নির্বাচন করার বাধা কোথায়? কীভাবে সেটা নিরসন করা যায়? এটা আলোচনার মধ্য দিয়েই সুরাহা হতে পারে। অন্য কোনো পথে নয়। অন্য কোনো পথে চেষ্টা করে যারা নির্বাচন বানচাল করে অসাংবিধানিক অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়, অসাংবিধানিক জিনিস আনতে চায়, তাদের প্রতিহত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। বগল বাজাবার কোনো সুযোগ নেই, বাহবা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার ফন্দিফিকির গত দিনেও (অতীতে) আপনারা করেছেন। আজকেও করার অপচেষ্টা করছেন। বিগত সময় যেমন জাতিসংঘ তারানকো সাহেবকে পাঠিয়েছিল, আমাদের দুই দলকে একসঙ্গে নিয়ে মিটিং করে বুঝেছিলেন। আজকেও প্রয়োজনে এই ধরনের গড়াগড়ি না করে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল আসুক।’
জোট নেতা ও সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি বা বিরোধীদের সঙ্গে সংলাপ হবে কি হবে না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন জোট নেতা শেখ হাসিনা। আমাদের জোটের সভায় এ রকম কোনো আলোচনা হয়নি। সমন্বয়ক সাহেব কেন এ কথা বললেন আমি তো জানি না।’
পরদিন বুধবার বিকেলে নিজের এমন বক্তব্য থেকে সরে আসেন প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরে আমু বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে জাতিসংঘ থেকে প্রতিনিধি তারানকোকে আনা হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা তাদের সামনে প্রমাণ করেছিলাম নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূনতা সৃষ্টি হবে। একটি দেশের জন্য সাংবিধানিক শূন্যতা কাম্য হতে পারে না। তাই সেই দিন আমাদের দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ধারাবাহিকভাবে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি জায়গায় আনতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।’
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আবারও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে আবার সেই নতুন বুলি। নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে নির্বাচনকে নিয়ে। কাউকে আহ্বান করার সুযোগ নাই। কাউকে আহ্বান করা হয় নাই। এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত না যে, দাওয়াত করে এনে খাওয়াব। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয় নাই, কাউকে দাওয়াত দেয়া হয় নাই। ২০১৩ সালের রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছিল সেই দিনও তোমরা আলোচনায় পরাজিত হয়েছিলে। তার মাধ্যমে আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল। আজকেও নির্বাচন হবে সংবিধানের ভিত্তিতে। দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না।
এদিকে বুধবার সকালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডিতে স্থাপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব, এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব, বিগত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী সংলাপের আহ্বান করেছিলেন। জাতিসংঘ কেন মধ্যস্থতা করতে যাবে? আমাদের দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক সংকট হয়নি যে জাতিসংঘকে এখানে ইন্টারফেয়ার করতে হবে। জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করবে এই রকম কোনো সংকট স্বাধীন বাংলাদেশে হয়নি।
তিনি বলেন, ‘এখানে বাইরের কোনো মধ্যস্থতা, বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ তো দরকার নাই। আমাদের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করব। সময় বলে দেবে কখন কী হবে। আপাতত আলাপ-আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমির হোসেন আমু আমাদের দলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। তার এ বক্তব্য নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে, সরকারের মধ্যে কোনো আলোচনা হয় নাই। এমনকি ১৪ দলের মধ্যেও কোনো আলোচনা হয় নাই। এটি সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত বক্তব্য।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ১৪-দলীয় জোট নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘জোট সমন্বয়ক উদাহরণ হিসেবে কথাটা বলেছেন। বিএনপি মহাসচিব যেভাবে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে তাদের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করার কথা বলেছেন, তাতে আমি মনে করি আলোচনার কোনো অবকাশ নেই।’
জোটের অন্যতম শরিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সময় হয়নি বলে মনে করি।’
এর আগে বিএনপি ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনার প্রসঙ্গ এলে এড়িয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা, না থাকার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হতে পারে যদি তাদের ইচ্ছে থাকে। যারা সংসদে নেই তাদের সঙ্গে আলোচনার কী আছে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা