দেশের বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দেখানো হয়। যেটা হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। বিষয়টি সঠিক নয়। যুদ্ধের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্ত শুরু হলেও এতদিন ধরে যে বেশি আছে, সেটা হয়েছে ব্যবস্থাপনার ভুলে। চাহিদার ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করা হয়নি। এ কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি কমেনি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ দৈনিক বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক বাংলার প্রতিবেদক ফারহান ফেরদৌস।
জাতীয় বাজেট দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বার্ষিক জাতীয় বাজেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের সরকার দেশের অর্থনীতি নিয়ে কী ভাবছে বাজেটে তা প্রকাশ পায়। বাজেটে সরকারের চোখে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝা যায়। পাশাপাশি সরকার কোন কোন বিষয়গুলো দেশের জন্য সমস্যা মনে করছে, আর বাজেটে দেশের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো সমাধানের পথও থাকে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে দেশের কোন সমস্যাগুলো সমাধানের পথ থাকার কথা ছিল?
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে চারটি সমস্যাকে প্রাধান্য দেয়ার দরকার ছিল। প্রথমটি হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়টি, দেশের উন্নয়নে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। তৃতীয়টি, দেশের ঘোষিত বাজেটে যে ঘাটতি ধরা হয়েছে সেটিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থায়ন করা এবং চতুর্থটি হচ্ছে দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো।
ঘোষিত বাজেট দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কী ভূমিকা রাখবে?
বিষয়টি নিয়ে কিন্তু কোনো বিতর্ক নেই যে, বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। গত অর্থবছরের বাজেট যখন ঘোষণা করা হয় তখন থেকে দেশের অর্থনীতি অস্থিতিশীল। আমরা দেখতে পাচ্ছি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট দেশের অর্থনীতির যে সমস্যা সেটা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি ছিল। ২০২২ সালের আগস্টে দেশের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছিল। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে বেশি। দেশের এই বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে দেখানো হয় বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। যেটা হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। বিষয়টি সঠিক নয়। দেশের মূল্যস্ফীতির এই বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। কিন্তু দেশে এই মূল্যস্ফীতি এতদিন ধরে যে বেশি আছে, সেটা হয়েছে ব্যবস্থাপনার ভুলে। দেশে চাহিদার ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করা হয়নি। এই কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি কমেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। আমেরিকায় ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারতে মূল্যস্ফীতি ৭ দশামক ৮ শতাশ থেকে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। আর ভিয়েতনামে মূল্যস্ফীতি ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা গেছে। সরকার দেশে সুদের হার না বাড়িয়ে কর হার বাড়িয়ে আমদানিকে কঠিন করে দিয়েছে। এর ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। এটা থেকে বোঝা যায়, আমদানি কমানো কোনো দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হতে পারে না। এটা সাময়িক পদক্ষেপ হতে পারে। সরকারের এই সব নীতি দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক ক্ষতি বয়ে এনেছে। দেখা গেছে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো দেশে থেকে টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। এসব নীতির কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। তাই ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ অংশে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। আর এই খারাপ হওয়ার পিছনে গত বাজেটের কিছু অবদান আছে। গত বাজেটে দেখা গেছে, সরকার অনেক বড় ঘাটতি বাজেট ধরেছিল। আর এই ঘাটতির টাকা তারা দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নিয়ে পূরণ করেছিল। এর ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের থেকে শিক্ষা নিয়ে কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করার দরকার ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনো শিক্ষা না নিয়েই এই বাজেট করা হয়েছে। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ। ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, এটা আগের বাজেটের মতোই। এই বাজেটে অনেক বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করা হয়নি। ব্যাংক থেকে ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্য কমানো হয়নি। ফলে খুব সহজেই বলা যায়, এই বাজেট আগের বাজেটের মতোই। এই বাজেটের লক্ষ্য প্রবৃদ্ধি বাড়ানো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়।
ঘোষিত বাজেটের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। সে জন্য এই বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? যা নেয়া হয়েছে তা কি সঠিক?
দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে চাইলে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। বেশি রাজস্ব আসে কর থেকে। সরকার প্রতিবছর একটি লক্ষ্যমাত্রা নেয় রাজস্ব আহরণের, সেটা কোনোবার পূরণ হয় না। ২০২২-২৩ সালের বাজেটেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার দেশ থেকে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করে। সেখান থেকে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয় ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু যতটুকু দেখা যাচ্ছে, কর আহরণ হবে আসলে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। যেটা লক্ষ্য থেকে ১৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশে কম কর আহরণ হচ্ছে। ফলে কর জিডিপির রেশিও কমে যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর জিডিপির রেশিও ছিল ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। যেটা গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় কম কম। ওই অর্থবছরে কর জিডিপির রেশিও ছিল ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। করব্যবস্থাকে ভেঙে ঢেলে না সাজালে কর আহরণ বাড়বে না। এবারের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের আহরিত রাজস্ব থেকে ৩৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু গত ৬ বছরের হিসাব থেকে দেখা গেছে প্রতি বছরে গড়ে রাজস্ব আহরণ ১০ শতংশ করে বাড়ছে। তা হলে বোঝা যাচ্ছে এবারো রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। কর আহরণ বাড়াতে দেশের করব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। এর মধ্যে কর পরিকল্পনা ও কর প্রশাসনকে আলাদা করতে হবে। এনবিআরকে আধুনিক করতে হবে। পাশাপাশি বিশদ পরিকল্পনা করে করব্যবস্থা সাজাতে হবে। এ ছাড়া সরকারি কোম্পানিগুলোকে আধুনিকভাবে সাজাতে পারলেও কর বাড়বে।
বাজেট ঘাটতি বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থায়ন করা একটি চ্যালেঞ্জ। এটি মোকাবিলায় বাজেটে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?
বাংলাদেশ সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে রাখা। আর একটি সমস্যা হচ্ছে এই ঘাটতি সঠিকভাবে অর্থায়ন করা। সরকারকে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ সরকার যদি ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয় তা হলে বেসরকারি খাত আর ঋণ নাও পেতে পারে। সরকারকে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ করতে হবে। বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে সরকারের জন্য সবচেযে ভালো হবে বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ নেয়া। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি। সবচেয়ে ভালো হবে ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে সরাসরি দেশের জনগণের কাছ থেকে টাকা নেয়া।
ব্যক্তিপর্যায়ে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আদায়ের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?
ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আয়কর আইনের মূলনীতির পরিপন্থী। এই কর থাকা উচিত নয়। এটা সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত। একদিকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে কর মুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলো। অন্যদিকে আবার যাদের আয় নেই তাদের ২ হাজার টাকা কর দিতে বলা হচ্ছে। এভাবে চলে না। বাংলাদেশের ধনীরা কম কর দিচ্ছে। সরকার গরিবদের কাছে দুই হাজার টাকা দান-খয়রাত নিয়ে চলতে পারে না। যেখানে ১০ শতাংশ ধনীর হাতে মোট সম্পদের ৩৫ শতাংশ রয়েছে। কর আদায় বাড়াতে সেখানে হাত দেয়া দরকার। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মার্গারেট থ্যাচার পোল ট্যাক্স নামে এ ধরনের কর আরোপ করেছিলেন, পরে সেটি প্রত্যাহার করেন।
দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে এই বাজেট কতটা সফল হবে?
রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। ঠিকমতো সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ করা যাচ্ছে না। বাজেটের ৫০ শতাংশ চলে যায় বেতন-ভাতা, পেনশন বা সুদ মেটাতে। রাজস্ব আহরণ কম হলে উন্নয়ন করা যায় না। সরকারের এখন উচিত হবে বড় বড় প্রকল্পে বেশি বেশি টাকা না ঢেলে মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্যসহ সামাজিক নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করা। কারণ বড় প্রকল্প সাধারণ মানুষকে দ্রুত উপকার দিতে পারে না। তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষায় ব্যয় বাড়ালে দেশের জনগণ দ্রুত সুবিধা পাবে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা