মাহফুজ নান্টু, কুমিল্লা
ধর্মসাগর। নাম শুনলেই অনেকের চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠতে পারে সৈকতে ঢেউ আছড়ে ফেলা কোনো সাগর। কিন্তু ধর্মসাগর প্রকৃতপক্ষে সাগর নয়, বিশালাকার এক দীঘি। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এর অবস্থান। এত বড় জলাধার কুমিল্লা শহরের আশপাশে কোথাও নেই। সাড়ে ৫০০ বছর আগের ধর্মসাগর তাই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক তো বটেই, ক্রমেই ইট-কংক্রিটের নগরে রূপ নেয়া কুমিল্লার জন্য এক টুকরো স্বস্তির জায়গাও। ‘কুমিল্লার ফুসফুস’ বলেই তাই ধর্মসাগরকে অভিহিত করে থাকেন স্থানীয়রা।
সকাল-বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের ভিড় লেগেই থাকে এই ধর্মসাগরের পাড়ে। কেউ বসে থাকেন বিষণ্ন মনে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেন। পাড় লাগোয়া বেঞ্চে বসে বান্ধবীর হাত ধরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনেন কোনো তরুণ। কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু মুক্ত বাতাসের সন্ধান করেন ধর্মসাগরের চারপাশে। কত শত প্রেম-বিচ্ছেদ, কত নির্মম মৃত্যুর সাক্ষী এ ধর্মসাগর!
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৪৫৮ সালে ত্রিপুরারাজ ধর্মমাণিক্য খনন করেন এই দীঘি। আয়তন ২৩ দশমিক ১৮ একর। এই অঞ্চলের মানুষের পানির কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। ‘রাজমালা’ গ্রন্থ আনুযায়ী, মহারাজা ধর্মমাণিক্য রাজত্ব করেন দীর্ঘ ৩২ বছর। তার নামেই দীঘির নামকরণ হয় ধর্মসাগর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লা ভ্রমণে এলে সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মণের সঙ্গে যেসব জায়গায় সময় কাটাতেন, তার মধ্যে ধর্মসাগর ও এর আশপাশের এলাকা অন্যতম।
লেখক ও ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর জানান, ধর্মসাগর যখন খনন করা হয় সেই সময়টা মধ্যযুগ। সেই সময়টা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ হিসেবেও বিবেচিত হয়। ওই সময় সুপেয় পানির অভাব ছিল। সে সময় এ অঞ্চলে যেসব রাজা শাসন করতেন তারা প্রজাদের সুপেয় পানির জন্য কিছু দীঘি খনন করেন। ধর্মসাগর, জগন্নাথ দীঘি, নানুয়ার দীঘি ও উজির দীঘি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আহসানুল কবীর বলেন, বর্তমান যে ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে, তার শুরুটা মূলত ওই সময়কার রাজাদের হাত ধরে। তবে এমন ঘটনার অন্যতম ভালো উদাহরণ রাজা মাণিক্য বাহাদুর। তিনি তখন তার রাজ্যর লোকদের জন্য ধর্মসাগর খনন করেন।
ধর্মসাগর নিয়ে নানা জনশ্রুতির কথা তুলে ধরে এই গবেষক বলেন, প্রায় চার হাজার শ্রমিক দুই বছর ধরে এই দীঘি খনন করেন বলে প্রচলিত রয়েছে। এই ধর্মসাগর খনন উপলক্ষে অন্তত ২৯ জন ব্রাহ্মণকে রাজা ধর্মমাণিক্য নিষ্কণ্টক ভূমি দান করেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। এ ছাড়া রাজা মাণিক্য বাহাদুর অসিয়ত করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর যারাই ধর্মসাগরটি রক্ষণাবেক্ষণ করবেন তারা দাসানুসারে জীবনযাপন করবেন।
সময়ের পরিক্রমায় এখন আর সুপেয় পানির জন্য ধর্মসাগরের ওপর নির্ভর করতে হয় না কুমিল্লাবাসীকে। তবে সাড়ে ৫০০ বছর আগের সেই দীঘি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যে। ধর্মসাগর ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। দলবেঁধে হাঁটা, যোগ ব্যায়াম, পথশিশুদের বিনামূল্যে পড়ালেখা করানো- এ রকম বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে সংগঠনগুলো। বিকেলে দর্শনার্থীদের নৌকা ভ্রমণের সুযোগও রয়েছে এই দীঘিতে।
ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে রয়েছে পথশিশুদের জন্য অবকাশ স্কুল। ওই স্কুলের সভাপতি ও শিক্ষক আজমীর হোসেন ইমন বলেন, স্কুলটিতে ৬৭ জন শিশু নিয়মিত পড়তে আসে। এই ধর্মসাগরটাই আমাদের অনুপ্রেরণা।
ধর্মসাগরপাড়ে ঘুরতে আসা কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক কাজী বেলায়েত উল্লাহ জুয়েল বলেন, ‘আমার কাছে ধর্মসাগর পাড়কে সুস্থ মনন বিকাশের আদর্শ পরিবেশ বলে মনে হয়। স্কুলজীবন থেকে শুরু, এখনো নির্মল বাতাসের খোঁজে পরিবারসহ আমরা যারা কুমিল্লা শহরবাসী তারা ধর্মসাগরের পাড়কেই প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করি।’
ইতিহাস-ঐতিহ্যর এই স্মারক দীঘি রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানালেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ড. সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দীঘিটির বিভিন্ন পাড়ে বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছিল। আমরা সেগুলো উচ্ছেদ করেছি। এই দীঘি রক্ষণাবেক্ষণসহ সৃজনশীল পদক্ষেপ নিতে নানা শ্রেণি-পেশার অংশীজনদের নিয়ে একটি কমিটি করতে চাই। আমরা আশাবাদী, এ রকম হলে ধর্মসাগরের সৌন্দর্য আরও বাড়বে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা