আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০৯:৫৩
জনগণের কল্যাণে সব চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন দরকার

জনগণের কল্যাণে সব চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন দরকার

আবুল কাসেম ফজলুল হক। ছবি: দৈনিক বাংলা

আবুল কাসেম ফজলুল হক

গবেষক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তার যুক্তিগ্রাহ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষণামূলক রচনা আমাদের চেতনা ও বিবেচনাবোধকে শাণিত ও সমৃদ্ধ করে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও উন্নতির জন্য লেখেন। সে সব নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সাহিত্যিক শামস সাইদ।

প্রশ্ন: বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য বা পরিচয় কী? এর উৎপত্তি হয়েছে কখন?

উত্তর: জাতি কথাটাকে নেশন অর্থে ধরছি। আমাদের জাতিবিষয়ক ধারণা, গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা- ইংরেজ শাসনামলেই সূচিত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সেই ধারণা আজও পর্যাপ্ত হয়নি। নানা ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভের পর আমরা জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাগ, পাঞ্জাব ভাগ ও ভারত ভাগ করে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি জিন্নাহ ও নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি নেহেরুর কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করে যায়। এতে ভারত উপমহাদেশে জাতি-সমস্যার সমাধান হয়নি। ইংরেজ-শাসনোত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে যেগুলোকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলা যায়। কাশ্মীর, পাঞ্জাব, পূর্ব ভারতের সাতটি প্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি প্রদেশে অনেক বছর ধরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে। তা সফল হয়নি। পাকিস্তানকালে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। গোটা বিশ শতক আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো, জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ, স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা- রাজনীতিতে এগুলো আমাদের সাফল্য। কিন্তু গণতন্ত্রের দিকে আমাদের অগ্রগতি কম। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কি জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে চলতে পারছি? জাতি, জাতীয়তাবোধ, জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, গণতন্ত্র ও অন্যান্য রাজনৈতিক বিপ্লব, আদর্শ, ধর্ম, মৌলবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের ধারণার পরিচ্ছন্নতা, ব্যাপ্তি ও গভীরতা দরকার। এর জন্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। জনগণের রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। গত প্রায় চল্লিশ বছরের মধ্যে যেসব পরিবর্তন ঘটে গেছে তাতে জনগণের কল্যাণে সব চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিই নবায়ন দরকার।

প্রশ্ন: জাতিকে আপনি কীভাবে আলাদা করবেন? ভাষা, ধর্ম, না সংস্কৃতি দিয়ে? ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে কেন আমরা উপজাতি বলে থাকি?

উত্তর: বাঙালির জাতীয় পরিচয়, তারা বাঙালিই। বাঙালির স্থলে কেউ বাংলাদেশিও বলতে পারেন। এ নিয়ে বিতর্ক অবাঞ্ছনীয়। জাতীয়তাবাদের ধারণা ইংরেজ শাসনামলেই দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার, জিন্নাহ, নেহেরু, গান্ধি [ভারতের জাতি-সমস্যার সমাধান করেননি, করতে পারেননি। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির চেষ্টা (১৯৪৭ থেকে ৭১) সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতীয়তাবাদের ইতিহাস রচনা করলে তাতে দেখা যাবে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের বর্তমান ধারণা গড়ে উঠেছে। নানাভাবে বিভিন্ন সময়ে আমাদের জাতীয়তাবাদের ধারণা বিকৃত এবং বিভ্রান্ত করা হয়েছে। বিকৃত ও বিভ্রান্তির গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অবশ্যই জাতীয় সাধনা ও জাতীয় সংগ্রাম লাগবে। জাতি গঠনের মূল ধারণা ভূভাগের ওপর নির্ভর করে। তারপর ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা আসে। যারা এখন বিশিষ্ট নাগরিক বলে আত্মপরিচয় দেন তাদের কারও ধারণাকেই আমার কাছে ঠিক মনে হয় না। এর জন্য নতুনভাবে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। গতানুগতিক ধারায় চলতে থাকলে জনগণেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। তাই জনগণকে জাগতে হবে। রাষ্ট্রের ভেতরই একাধিক ধর্ম, একাধিক ভাষা, ক্ষুদ্র নানা জনগোষ্ঠী থাকে। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য দরকার ঐক্যের নীতি। বৈচিত্র্য ও ঐক্য- দুটোতেই গুরুত্ব দিতে হবে। বহুত্ববাদ কথাটা সম্প্রতি সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জাতিগঠন, রাষ্ট্রগঠন, জাতীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিকাশের জন্য এই ধারণা ক্ষতিকর। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর সার্বিক উন্নতির সুযোগ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। তাদেরকে গোটা মানবজাতির মূল ধারায় আসার সুযোগ সরকারকে সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ইউনেসেফ ও সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে যেসব কথা প্রচার করা হয় সেগুলোতে অনুচিত অনেক কিছু থাকে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে কোনো কোনো মহল থেকে আদিবাসী বলা হয়। এর দ্বারা যে তাদের অসম্মান করা হচ্ছে তা মনে করার কারণ নেই। উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী- সবই বলা এবং লেখা যেতে পারে।

প্রশ্ন: ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার সেকাল ও একাল সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

উত্তর: পরাধীনতা অত্যন্ত ক্ষতিকর ও অসম্মানজনক ব্যাপার। স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা রক্ষা করে চলা লাভজনক ও সম্মানজনক। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিশীলতাও অপরিহার্য। আমাদের আরও উন্নতির সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল। সুযোগের সদ্ব্যবহার যথেষ্ট পরিমাণে করা হয়নি, অনেক ভুলত্রুটি আছে। গত ১০০ বছরের ধারার দিকে তাকালে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, অনেক উন্নতি হয়েছে। উন্নতির জন্য রাজনীতিবিদদের ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। জনগণের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বছর দশেকের মধ্যেই জনগণ ঘুমিয়ে পড়ে। উন্নত প্রযুক্তি ও প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করা হয়েছে জনসাধারণকে ঘুম পাড়ানোর জন্য। জনগণ জেগে থাকলে এত অনাচার ও অন্যায় চলতে পারত না।

প্রশ্ন: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আমাদের বাঙালির ভাষার জাতীয়তাবাদ। আপনি কি মনে করেন ভাষার জাতীয়তাবাদই একাত্তরে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছে?

উত্তর: আন্দোলনটা ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে, বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। পাকিস্তানকালে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এবং পরে পূর্ব বাংলাব্যাপী যেসব অনুষ্ঠান হতো তাতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার উন্নতি ও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি থাকত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকায় ‘বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। আইয়ুব খানের সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপারটিকে যখন সামনে আনা হয় তখন থেকেই পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন এবং আন্দোলন পর্যায়ক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয়। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সব সময়ই ছিল। তার সঙ্গে অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা এবং স্বতন্ত্র সংস্কৃতির কথা যখন সামনে আনা হয় তখন আন্দোলনের গতি ক্রমে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে চলে যায়। প্রকৃত ব্যাপারটা বোঝা যাবে পক্ষপাতমুক্ত অনাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে।

প্রশ্ন: শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি দেশ, সমাজ ও বিশ্বেও নেতৃত্ব দেয় বলে মনীষীগণ মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি কতটা আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে?

উত্তর: আমি অনুভব করি, জাতীয় নেতৃত্ব শিল্প-সাহিত্যে ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা যেমন হওয়া উচিত তা থেকে অনেক নিচে পড়ে আছে। যারা বিশিষ্ট নাগরিক বলে নিজেদের পরিচয় দেন তাদের বৌদ্ধিক চরিত্র কী খুব উচ্চ মানের? একদিক দিয়ে তারা খুব শক্তিশালী। তারা সরকারি বুদ্ধিজীবী এবং তারা কখনো কখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণ শক্তিরূপে কাজ করেন।

প্রশ্ন: স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের অগ্রগতি কতটা হয়েছে?

উত্তর: পরিমাপগত দিক দিয়ে অগ্রগতি অনেক হয়েছে। কিন্তু গুণগত দিক দিয়ে অগ্রগতি অল্পই হয়েছে।

প্রশ্ন: ভূখণ্ডের স্বাধীনতা লাভ করেছি, কিন্তু শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা কতটা লাভ করেছি?

উত্তর: এখন আমাদের যে জাতীয় চরিত্র তা আগের তুলনায় দুর্বল। সরকার বলি, রাজনৈতিক দল বলি, বিশিষ্ট নাগরিক বলি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র বলি- সর্বত্রই দুর্বলতা প্রকট। এই রকম জাতীয় চরিত্র নিয়ে বড় কিছু করা যায় না। এই রকম চরিত্র নিয়ে কী স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো?

প্রশ্ন: অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব কতটুকু?

উত্তর: শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম; উন্নতির জন্য অপরিহার্য। এ দেশে ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী মানসিকতা নিয়ে শিল্প-সাহিত্য ও দর্শন-বিজ্ঞান চর্চার যে বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে সৃষ্টিশীলতা মার খেয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: একটি জাতির ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি সেই জাতির বিকাশে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। জনপ্রিয় লেখার দ্বারা তরুণদের মন-মানসিকতা গড়ে ওঠে। আমাদের দেশেও তা হচ্ছে। তরুণদের মন-মানসিকতা গড়ে উঠছে ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী চেতনা নিয়ে। দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্র-শিক্ষকদের উন্নত চিন্তা-চেতনা সৃষ্টির সহায়ক নয়। জাতীয় মান দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে এ রকমই চলবে- এমনটা মনে করি না। পরাজিত চিন্তা-চেতনা ও ঘুমন্ত জনমন অবশ্যই জাগবে এবং উন্নতির চেষ্টা করবে। জীবনের লক্ষ্য কি ভোগের বাসনাকে অধিক থেকে অধিকতরভাবে চরিতার্থ করা?

প্রশ্ন: বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষায় ও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার তেমন ব্যবহার নেই। এটাকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?

উত্তর: বিচারব্যবস্থায়, বিশেষ করে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে বাংলা চালু করার জন্য সরকারের উদ্যোগী ও সচেষ্ট হওয়া উচিত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের’ মতো বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের উচিত ‘বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

প্রশ্ন: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা আধুনিক ও যুগোপযোগী?

উত্তর: এ প্রশ্নের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- অসুস্থ, রুগ্ন শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে সুস্থ ও রোগমুক্ত করা যাবে?

প্রশ্ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও পরে শিক্ষক। এই দুই অবস্থান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন করুন।

উত্তর: পাকিস্তানকালে ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে যখন ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি তখন থেকে এখনকার অবস্থা অনেক খারাপ। বাংলাদেশ ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। অবস্থা যে ভালো করা যাবে সে বিশ্বাস ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের মনে সৃষ্টি করা দরকার। বিবেকবান চিন্তাশীল লোকরা তার সূচনা করতে পারেন। কোনো কোনো প্রচারমাধ্যম তার সূচনা করতে পারেন।

প্রশ্ন: বই পড়া মানুষের সংখ্যা কমছে। হয়তো এই সংখ্যা আরও কমবে। এই যে বই না পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: তথ্যপ্রযুক্তির যে বিপ্লর ঘটেছে প্রধানত তার জন্য এমনটি ঘটেছে। বইয়ের দ্বারা যা সম্ভব তা অন্যকিছু দ্বারা সম্ভব হয় না। ক্রমে লোকে এটা বুঝবে। জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের পাঠক কমেনি, বেড়েছে। কিন্তু সিরিয়াস বইয়ের পাঠক কমেছে। পাঠক না থাকলে সিরিয়াস বই প্রকাশিত হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের চাকরির প্রয়োজনে যেসব গবেষণা হয় সেগুলো দ্বারা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের উন্নতি হয় না। কল্যাণকর বই লেখার জন্য এবং গবেষণার জন্য দরকার আন্তরিকতা ও স্বাধীন চিন্তাশীলতা।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে সংস্কৃতি অঞ্চল ও জাতিভেদে আলাদা। শহুরে সংস্কৃতির দুর্বার প্রবাহে গ্রাম-বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা হতে যাচ্ছে। এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

উত্তর: প্রগতির দাবি বুঝতে হবে। বাইর থেকে উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রয়োজনীয় নানা কিছু গ্রহণ করতে হবে। কিছু জিনিস বিলুপ্ত হয়ে যাবে, কিছু জিনিস সৃষ্টি হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সব কিছুকে রক্ষা করা যাবে না এবং নতুন জিনিস গ্রহণ না করে অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে না। গ্রহিষ্ণু ও সহিষ্ণু মনোভাব দরকার।

প্রশ্ন: ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে সরকারের ভূমিকা কতটা?

উত্তর: সৃষ্টিশীল সরকারের দায়িত্ব আছে। যেমন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। তা কী সরকার করবে? সরকার তো লেখকদের জন্য অনেক পুরস্কার দিয়ে থাকে, যাদের পুরস্কার দেয়া হয় তারা কি সৃষ্টিশীল? কী তাদের সৃষ্টি? সৃষ্টিশীল প্রগতিশীলরা সাধারণত পৃষ্ঠপোষকতা পান না।

প্রশ্ন: তরুণদের উদ্দেশ্যে বলুন। আমাদের কী করা উচিত।

উত্তর: নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের নিয়ে ক্ষমতাসীন ও ধনী লোকদের বেশ কিছু প্রচারমাধ্যমে অনেক কথা প্রচার করেন। তারা এ ব্যাপারে চেষ্টাও করেন। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা চরম দুর্গতির মধ্যে আছে। মনুষ্যত্বের চর্চা দরকার। উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে যে প্রাচুর্য দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যায়-অবিচার বাড়ছে। মানুষের মধ্যকার পাশবিক প্রবণতা বাড়ছে, মনুষ্যত্ব, মানবতা দুর্বল হচ্ছে। ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী প্রবণতা ও লিপ্সা নিয়ে চললে মনুষ্যত্ব মূল্য পাবে না। এটা শিশু-কিশোর নিজেরাও বুঝবে এবং এক দিন নতুন সামাজিক ও জাতিশক্তি দেখা দেবে। গোটা মানব-প্রজাতিই এখন ভোগবাদী, ধনতান্ত্রিক প্রবণতা নিয়ে চলছে। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। শিশু-কিশোর-তরুণদের থেকে নবচেতনা জাগ্রত হবে- এটা আশা করি। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার চরণ মনে পড়ছে: ‘আশা রেখো মনে, দুর্দিনে কভু নিরাশ হয়ো না ভাই। কোনো দিন যাহা পোহাবে না হায়, তেমন রাত্রি নাই।’