আপডেট : ১২ জুন, ২০২৩ ১০:০২
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন সম্ভব নয়
মো. সাখাওয়াত হোসেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন সম্ভব নয়

সংবিধানের বাইরে গিয়ে গঠিত সরকার বাংলাদেশের জন্য কখনোই কল্যাণকর ছিল না। উল্টো নানাভাবে ওই সরকারগুলো বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিভিন্ন সম্পর্কে টানাপোড়েনের জন্য বহুভাবে দায়ী। আপাত দৃষ্টিতে বলা যায়, অসাংবিধানিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে রাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে অমর্যাদার শিকার হয়ে থাকে এবং এর রেশ বয়ে যেতে হয় সাধারণ জনগণের। প্রকৃত অর্থে, জনমানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, শোষকশ্রেণির দাপটে শোষিতরা নিষ্পেষিত ও বঞ্চিত হয়ে থাকে। নিত্যপণ্যের জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম ভোক্তাদের বেকায়দায় ফেলে দেয়। বিদেশি বন্ধুদের পক্ষ থেকে নানাবিধ খড়্গ নেমে আসে। ক্রমান্বয়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে আসতে থাকে। দেশের অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের রাজত্ব কায়েম হয়। পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক, সেনাশাসিত সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে সংবিধান লঙ্ঘনসহ গুরুতর আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রের মূল ভিতকে নষ্ট করে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে স্বৈরশাসক ও সেনাশাসিত সরকারকে জনগণ পদত্যাগে বাধ্য করায় গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এর কিছু দিন পর ১/১১-এর কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘায়িত হয়ে সেনাশাসিত সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতিবিদদের ওপর চড়াও হয় এবং মাইনাস টু ফর্মুলার নামে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে। শেষঅবধি ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের তুমুল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এবং বিপুল জনমত নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

’৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসক হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর দেশ শাসন করেছেন জিয়াউর রহমান। ৭০ দশকের আর দশজন সামরিক শাসকের মতোই তিনি ছিলেন কঠোর। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তিনি ছিলেন পটু। সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার সময়। স্বাধীনতার পরে নিষিদ্ধঘোষিত জামায়াতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি ইসলামি দল সেই সময়েই আবার রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেয়া হাইকোর্টের রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনকেও সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত।

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালত রায়ে বলেছেন, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের জারি করা সামরিক শাসন, এরপর থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সকল সামরিক আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন আদেশ ও সামরিক আইন নির্দেশ অবৈধ। রায়ে আদালত বলেছেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি সংবিধান স্থগিত করেন ও মূল কিছু বিধান পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু এরশাদ কেবল সংবিধান স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু কোনো বিধান রদবদল করেননি। এরশাদ অন্যায় করেছেন। তবে জিয়াউর রহমান গুরুতর অন্যায় করেছেন।

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময় ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৭২-এর সংবিধানের সঙ্গে বিষয়টি সাংঘর্ষিক। ৭২ সালে যে সংবিধান প্রবর্তিত হয়েছিল সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিধান ছিল এই কারণে যে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ দেশমাতার টানে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল। তাই দেশটি প্রত্যেক ধর্ম অনুসারীদের। এরশাদ মূলত রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব ও ধর্মীয় রাজনীতির বিস্তার ঘটান। বিভিন্ন ইসলামপন্থি দল এবং সংগঠনকেও মদদ দিতে থাকেন জেনারেল এরশাদ। তা ছাড়া নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিতর্ক নিয়ে এরশাদ মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন।

ক্ষমতায় টিকে থাকতে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য জেনারেল এরশাদ সামরিক গোয়েন্দাদের ব্যবহার করেন। সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়ে তিনি ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে দুটি বিতর্কিত নির্বাচন করেন। অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের তুষ্ট রাখার জন্য সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান করেন এরশাদ। রাজনৈতিক দলগুলো যখন একাট্টা হয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে তখন এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।

ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেনারেল এরশাদের দুর্নীতি নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ১৯৮৬ সালে ব্রিটেনের দ্য অবজারভার পত্রিকায় মরিয়ম মমতাজ নামে এক নারী নিজেকে এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে বলেন, জেনারেল এরশাদ আমেরিকা এবং সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং ওয়াশিংটন পোস্টসহ নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের শিরোনাম হয়েছিল। দুর্নীতির মামলায় কারাগারেও থাকতে হয়েছে তাকে।

পরবর্তীতে সামরিক সমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যোগ নিয়েছিল। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার কথা ছিল সেটি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লঙ্ঘিত হয়। ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদও গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর আবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফখরুদ্দীন আহমদ। ওই সময় মূলত আওয়ামী লীগের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রাটা তুলনামূলক বেশি ছিল। তবে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার একটি অপপ্রয়াস তাদের মধ্যে ছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে চোখের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পর তাকে দেশে ফিরে আসতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তিনি সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৬ জুলাই ধানমন্ডির সুধা সদন থেকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সংসদ ভবনের পাশে অস্থায়ী জেলখানায় আদালত বসানো হয়। আদালতে বিভিন্ন মামলার শুনানিও চলতে শুরু করে। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করলে তা ব্যাপকভাবে সমর্থন লাভ করে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় তৎকালীন সরকার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহল থেকে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার চাপ বাড়তে থাকে। অস্থায়ী কারাগারে বন্দি শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়লে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে ফেটে পড়েন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা খুব দ্রুতই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আন্দোলনে কাবু করে ফেলে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাধ্য করে।

সুতরাং, বাংলাদেশের সংবিধানে স্বৈরশাসক-সামরিক শাসক এসবের কোনোরূপ ভিত্তি নেই। এ সরকারগুলো অসাংবিধানিক এবং বাংলাদেশের মানুষও পরবর্তী সময়ে এ সময়কারগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এখন সংবিধানে নেই, তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বর্তমান সংবিধান মোতাবেক কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সম্ভব হবে তখনই যখন পার্লামেন্টের মেম্বাররা সংসদে দাবি উত্থাপন করে সংবিধান সংশোধনের দাবি জানাবে এবং তাতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করবে। এর বাইরে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযোগ নেই। বাংলাদেশে পরিচালিত অসাংবিধানিক সরকারগুলো রাষ্ট্রের জন্য কখনোই হীতকর ছিল না এটি এখন নানাভাবে প্রমাণিত। কাজেই বাংলাদেশের জনগণও সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে আসন্ন নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য আগ্রহী হয়ে আছে।

সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠিত হলে জনগণের ভোটাধিকার সুরক্ষিত থাকে। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলের মাধ্যমে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণের সুযোগ পায় সেখানে জনমতের প্রতিফলনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। এই জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের নিকট তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের কারণে দায়বদ্ধ থাকে এবং জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে যেসব সরকার বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে আদালতের আদেশের মাধ্যমে সেই শাসনকালকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণও অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীদের বয়কট করেছে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়