ইব্তেসাম আফরিন
কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আমি যখন পিএইচডি শুরু করি, তখন মানুষ সবে লকডাউনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা এটা। অ্যাডমিশন লেটার এসে পৌঁছেছিল ঠিকই, তবে ঝামেলা দেখা দিল পাসপোর্ট নিয়ে। সে সময় পাসপোর্ট অফিসের প্রিন্টিং সমস্যায় নতুন ইস্যু করা পাসপোর্ট হাতে এসে পৌঁছতে বাড়তি সময় লেগেছিল।
উচ্চশিক্ষার্থে যারা বিদেশে গিয়েছেন, তারা হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝবেন। আইইএলটিএস, ভর্তির আবেদন ফি, আগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ট্রান্সক্রিপ্ট তোলা, এমন নানান সব কাজে সঞ্চিত অর্থ ততদিনে তলানিতে পৌঁছেছে। কোভিডের কারণে সীমান্ত বন্ধ থাকায় এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে সেপ্টেম্বর সেশনে সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ আমার হলো না।
এদিকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমার কর্মস্থল থেকেও ছুটি নিয়ে নিয়েছি। অগত্যা যতদিন কানাডায় পড়তে যাওয়ার স্টাডি পারমিট না পাচ্ছি, ততদিন পরিবারের সহযোগিতায় দিন কাটতে লাগল। অনলাইনে ক্লাস শুরু করলাম। দিন-রাত মিলিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টার বিশ্রামের ওপর নির্ভর করে প্রথম বর্ষের প্রথম টার্ম চালিয়ে নিই। কেবল মানসিক শক্তির জোরে নিজেকে চালিয়া নিচ্ছি। তখন পর্যন্ত ভরসা একটাই- আমার ফুল ফান্ডিং অফার আছে, আর বর্তমানের যে দুরবস্থা তা হয়তো শিগগিরই কেটে যাবে।
অবশেষে ভিসা-সংক্রান্ত সব জটিলতা কাটিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কানাডার অন্টারিওতে আমার ক্যাম্পাসে পৌঁছাই। ততদিনে বিমান ভাড়াটা জোগাড় করে দিয়েছে আমার বাবা ও আপুরা। তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কানাডায় পড়ার আগে আমার ইংল্যান্ডে পড়ার অভিজ্ঞতা আছে। সেবার কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে ডারহাম ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে গিয়েছিলাম। তাই এ যাত্রায় জীবনযাপনের ধারা নিয়ে আমি ভালোই আত্মবিশ্বাসি ছিলাম। তবে এখানেই বাদ সাধে বৈদেশিক মুদ্রার চড়া বিনিময় হার।
স্কলারশিপ এজেন্সি পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করলেও আরও কত শত খরচের খাত যে আছে! বৈদেশিক মুদ্রার তফাতটা তাই হাড়ে হাড়েই টের পেতে শুরু করি। আমি যখন কানাডায় এলাম, তখন এক কানাডীয় ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার মান ৬০-৬২ টাকার মতো। আর প্রতি মার্কিন ডলার কিনতে হতো সম্ভবত ৮০ থেকে ৮৪ টাকায়। কানাডা যাওয়ার আগ পর্যন্ত যেকোনো খরচ ডলারেই দিতে হচ্ছিল।
২০২১ সালে যখন কানাডায় পড়তে গেলাম, স্বাভাবিকভাবেই নিজের আবাস, খাবার খরচ, যাতায়াত খরচ- জীবন নির্বাহের জন্য যা যা প্রয়োজন তা চালিয়ে নেয়ার জন্য একটা শিক্ষার্থীবান্ধব বাজেট বানিয়ে ফেললাম। খেয়ে-পরে সমান সমান অবস্থা, ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল তখন। প্রয়োজনে ধারেকাছে কিছু জায়গায় ঘোরাঘুরিও করে ফেলেছি এরমধ্যে। তবে সময় যতই যাচ্ছে, বিশ্ব ততই অস্থিতিশীল হচ্ছে। এর প্রভাব আমিও যে টের পাইনি, তা বললে ভুল হবে। ছোট্ট দুটি উদাহরণ দিই।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আমি যেই কমলার ব্যাগ কিনেছিলাম ৪ ডলারে, এ বছর সেই একই জিনিসের দাম বেড়ে হয়েছে ৮ ডলার। ২০২১ সালে ৩ লিটার তেলের দাম মাত্র ৯ ডলার হলেও হাল আমলে তা বেড়ে প্রায় ১৫ ডলারে পৌঁছেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রায় প্রতিটি জিনিসের দামই দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
আমরা যারা শিক্ষার্থী, তাদের ২০২১ সালে তৈরি করা বাজেটে এখনকার বিদেশি বাজার প্রেক্ষাপট আর মিলছে না একদমই। ভর্তুকি দেয়ার কেউ নেই। টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্সের বেতন নামেমাত্র বেড়েছে, যা নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি সামাল দেয়ার মতো যথেষ্ট নয়। এমন সময়গুলোতে পরিবারের সেফটি নেটের কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে কানাডা আসার আগে তারা আমাকে যে রকমভাবে হাতটা ধরে রেখেছিল, তা কতটা অমূল্য।
ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবনযাত্রার খরচ। এমনকি ৬০-৬২ টাকার কানাডিয়ান ডলারের মূল্যমান এখন ৭৫ টাকার বেশি। যারা এ বছর বাংলাদেশ থেকে বাইরে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছে, আমি তাদের কথা ভাবি। বিমান ভাড়া, আবেদন ফি কিংবা পর্যাপ্ত টাকা ব্যাংকে দেখাতে গিয়ে তাদের গত বছরের চেয়ে ১২ শতাংশের বেশি খরচ হচ্ছে। মুদ্রামানের এই তফাত শুধু যে খরচের ওপর প্রভাব ফেলছে তা নয়, আমার মনে হয়, এটির প্রভাব আরো দীর্ঘস্থায়ী এবং গাঢ়।
আমার পর্যবেক্ষণে এর অন্যতম কারণ হলো, বাংলাদেশের প্রায় শিক্ষার্থীই যারা বিদেশে পড়তে যায় তারা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে। বিদেশে নিজেদের ভরণ-পোষণ যা-ই হোক না কেন, দেশের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে নড়চড় হতে দেখি নাই আমি অনেকের ক্ষেত্রেই। এখন, যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে আমি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি কিনা, ভেবে বলতে গেলে ক্ষতির মাত্রাটা ক্রমশ বর্ধমান। শুধু আমি না, যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্যই ডলারের মূল্য বৃদ্ধি বড় এক পেরেশানের কারণ। তবে, যেহেতু আমি স্কলারশিপ পাচ্ছি, আমি হয়তো তুলনামূলকভাবে ভালো আছি। কিন্তু, আমার পরিচিত অনেকেই আছেন যারা নিজস্ব ফান্ডে পড়াশোনা করছেন, তাদের জীবনের গল্প মহাকাব্যের চেয়ে কম নয়। তাই ডলারের দাম বৃদ্ধি শিক্ষার্থীদের জন্য অশনি সংকেতই দিচ্ছে।
মন্দের মধ্যেও যদি ভালো কিছু বলতে হয়, দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার সময় ডলারের দাম বৃদ্ধি যতটা না গতরে লাগে, বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠাবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মুখমণ্ডল যেন একটু উজ্জ্বল দেখায়। কারণ ডলারের দাম যে ১০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে! মুদ্রাস্ফীতি এই এক ক্ষেত্রেই মধুর মনে হলেও এর শেষ পরিণতির ভুক্তভোগী আমাদের মতো জনসাধারণই।
লেখক: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা