আপডেট : ১৫ জুন, ২০২৩ ১১:৩১
সিটি করপোরেশনে জাতীয় নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সাল
প্রভাষ আমিন

সিটি করপোরেশনে জাতীয় নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সাল

সবার নজর এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। এ বছরের ডিসেম্বরে বা সর্বোচ্চ আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোট গ্রহণের সময় ছয় মাসের কিছু বেশি সময় হাতে থাকলেও আর মাস চারেকের মধ্যেই আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ঢুকে যাব। তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে এরই মধ্যে। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, সেটা নিয়ে আলোচনার আরও অনেক সময় আছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচন দিয়ে দেশে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এটা ঠিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই জাতীয় রাজনীতিতে স্থানীয় নির্বাচনের কোনো গুরুত্ব নেই। তবু আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে স্থানীয় নির্বাচনগুলো জনগণের বাড়তি নজর পাচ্ছে। অনেকেই স্থানীয় নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সাল ভাবছেন।

এই দফায় পাঁচটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরই মধ্যে গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনায় নির্বাচন হয়েছে। আগামী ২১ জুন হবে রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন। যে তিনটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। বাংলাদেশের মানদণ্ড বিবেচনায় এই তিনটি নির্বাচনকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলা যাবে। গাজীপুর নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন মডেল নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছিল। নির্বাচন কমিশন তাদের দিক থেকে চেষ্টার ঘাটতি করেনি। কিন্তু তারপরও শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচনকে ‘মডেল নির্বাচন’ বলা যাবে না। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের মান বিবেচনায় নির্বাচন তিনটি ভালোই হয়েছে। কিন্তু রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেয়ায় নির্বাচনগুলো অংশগ্রহণমূলক হয়নি।

একটি ভালো নির্বাচনের অনেকগুলো ধাপ থাকে। তাকে হতে হয়, অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে একটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পর্যন্ত করতে পারে। কিন্তু সব বড় দল অংশ না নিলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে না। তাই এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার থাকে না। যেমন বিএনপি চলমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তাই নির্বাচন যত মডেলই হোক, সেটিকে অংশগ্রহণমূলক বলার কোনো সুযোগ থাকে না। অংশগ্রহণমূলক না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে। যেমনটি হয়েছে গাজীপুরে। বিএনপি অংশ না নিলেও গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম তার মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে লড়াই করে আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে প্রার্থী আজমত উল্লাকে হারিয়ে দিয়ে অংশগ্রহণমূলক না হওয়া নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলেছিলেন। তবে বরিশাল বা খুলনায় তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। রাজশাহী ও সিলেটেও নির্বাচন একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হবে সেটা বলেই দেয়া যায়। তবে বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জটিলতম টার্ম হলো ‘গ্রহণযোগ্য’। নির্বাচন যত অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হোক না কেন; গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো উপায় নেই। পরাজিত প্রার্থীর ফলাফল মেনে নেয়ার সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি। হারলেই কারচুপি, এটা অবধারিত অভিযোগ। তাই বাংলাদেশে কোনো দিনই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।

আগেই যেমনটি বলেছি, নির্বাচন কমিশন গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করার উপায় তাদের ছিল না। গ্রহণযোগ্যতার কথা তো আগে বলেছি। পরাজিত দল কখনোই ফলাফল গ্রহণ করে না। বাংলাদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার আরেকটি মাত্রা আছে। সরকারি দলের প্রার্থী হারলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়। যেমন গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরেছিল বলে, মোটামুটি সাধারণে একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। বরিশাল এবং খুলনায় প্রায় একই মানের নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এ দুই সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীরা জিতেছেন, তাই এখানে আলোচনা কম। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারতেই হবে।

পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ছিল গাজীপুর নিয়ে। তারপর বরিশাল। তবে খুলনা, রাজশাহী, সিলেট নিয়ে কারও কোনো কৌতূহল নেই। গাজীপুরের উত্তেজনার খবর তো আপনারা আগেই জেনেছেন। ‘জাহাঙ্গীরের মা’য়ের কাছে হেরে গেছেন ডাকসাইটে আজমত উল্লা। বরিশালে অবশ্য কোনো জাহাঙ্গীরও ছিলেন না, তার মাও ছিলেন না। গাজীপুরে ছিল দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর বরিশালে হলো, একেবারে কাহানি ঘর ঘর কা। অনেক দিন ধরেই বরিশালে আওয়ামী রাজনীতির একক কর্তৃত্ব ছিল আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর হাতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেঁচে যাওয়া এই ফুফাতো ভাইয়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর ছিল। বরিশাল সিটি করপোরেশনের আগের নির্বাচনে সরকারি দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছিলেন আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ। গত পাঁচ বছর তিনি বরিশালে একচ্ছত্র শাসন কায়েম করেছিলেন। বারবার শিরোনাম হয়েছেন নেতিবাচক কারণে। বরিশালবাসী বঞ্চিত হয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে। সবাই ধরে নিয়েছিলেন এটাই তাদের নিয়তি। সাদিক আব্দুল্লাহ মনোনয়নবঞ্চিত হবেন, বরিশালের কেউ এটা কল্পনাও করেননি। শেখ হাসিনার মনে ছিল ভিন্ন চিন্তা। সাদিক আব্দুল্লাহর বদলে তিনি বেছে নেন তার চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে। আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ মনোনয়ন বোর্ডে উপস্থিত থেকেও ছেলের মনোনয়ন ধরে রাখতে পারেননি।

রাজনীতিতে একেবারে অচেনা হলেও আবুল খায়ের আব্দুল্লাহও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দুটি গুলি শরীরে নিয়েও বেঁচে আছেন। সাদিক আব্দুল্লাহর দুঃশাসন থেকে মুক্তি মিলবে, এ আশাতেই উৎফুল্ল ছিল বরিশালবাসী। মনোনয়ন বদলের খবরেই চাঙা হয়ে যায় বরিশাল আওয়ামী লীগ এবং সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দুই পক্ষকে মেলানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। তবে দুই পক্ষেরই আগ্রহের ঘাটতি ছিল বলে সে চেষ্টা সফল হয়নি। মনোনয়নবঞ্চিত সাদিক আব্দুল্লাহর আগ্রহের ঘাটতিটা বোঝা গিয়েছিল সহজেই। তবে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর আগ্রহের ঘাটতিটা ছিল কৌশলগত। যদি তিনি সাদিক আব্দুল্লাহর সঙ্গে সমঝোতায় যেতেন এবং সাদিক আব্দুল্লাহর লোকজন তার পক্ষে মাঠে নামত; তাহলে বরিশালবাসী মনে করতে পারত, প্রার্থী বদল হলেও তাদের ভাগ্য বদল হবে না। তা ছাড়া দুই পক্ষ মিলে গেলে সাদিক আব্দুল্লাহর পাঁচ বছরের দুঃশাসনের দায় নিতে হতো আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে। তাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ সযতনে ভাই এবং ভাতিজাকে এড়িয়ে চলেছেন। ভোটের মাঠে সাদিক আব্দুল্লাহর লোকজন ছিল না এমনকি সাদিক আব্দুল্লাহ নিজেও ভোট দিতে আসেননি। তাদের এই না আসাটা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর জন্য শাপে বর হয়েছে। সাদিক আব্দুল্লাহ নির্বাচন মাঠে চাচার পক্ষেও ছিলেন না, প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করেননি। তাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ তার ক্লিন ইমেজ নিয়ে অনায়াসে নির্বাচনী বৈতরণী পেরুতে পেরেছেন।

ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের হাত পাখার বাতাস নৌকার জয়ের গতিপথ বদলাতে পারেনি। তবে নির্বাচনের দিন শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী ফজলুল করিমের রক্তাক্ত হওয়াটা পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কালিমা লেপন করেছে। ফজলুল করিমের রক্তাক্ত হওয়া প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের ‘তিনি তো ইন্তেকাল করেননি’ উক্তিও নির্বাচনী বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলেছে। ফজলুল করিমের ওপর যারা হামলা করেছে, নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভিডিও ফুটেজ দেখে, তাদের সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল। প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারাটা এবং পরেও ব্যবস্থা নিতে না পারাটা নির্বাচন কমিশনের বড় ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

গাজীপুর, বরিশাল এবং খুলনা সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানি আমি ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। তিন সিটি নির্বাচনেই ভোট দিয়েছেন কমবেশি ৫০ ভাগ ভোটার। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে কমতে তলানীতে এসে ঠেকেছিল। দলের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত জেনে এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটাররাও কেন্দ্রে যেতেন না। তবে গাজীপুর, বরিশাল, খুলনায় ছিল ভিন্ন চিত্র। সকাল থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। ‘ইভিএম’-এ ধীরগতির পরও ভোটাররা আগ্রহ হারাননি। আমার ধারণা, বিএনপি সমর্থকরাও নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ ফিরে আসাটা গণতন্ত্রের পথে বড় অগ্রগতিই মানতে হবে। সিটি নির্বাচন শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে গণতন্ত্র আরেক ধাপ এগুবে। প্রথম কথা হলো, আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। তাহলেই সেটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। ড্রেস রিহার্সালে তারা খারাপ করেনি। আশা করি চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও নির্বাচন কমিশন পাস করবে।

লেখক: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ