গত ১৫ মে রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় জাকির হোসেন নামে এক রোগীর মৃত্যুতে দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে অধ্যাপক ডা. গোলাম আজম, ডা. শেখর কুমার মণ্ডলসহ আরও চিকিৎসকের শাস্তির দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসিতে অভিযোগ দিয়েছেন জাকির হোসেনের স্ত্রী নুরুন নাহার।
অভিযোগে চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে কলাবাগান থানায় জিডিও করা হয়। তবে বিচার পাবেন কি না জানেন না নুরুন নাহার। কেননা, এ ধরনের অভিযোগে বিচার পাওয়ার নজির বাংলাদেশে নেই বললেই চলে।
চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের চিঠি সাধারণত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) বরাবর দিতে হয়। দেশে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা বা ভুলের অভিযোগ থাকলে তার বিচার করে বিএমডিসি। চিকিৎসকদের পেশা চর্চার অনুমতি দেয় বিএমডিসি। অসদাচরণ, অবহেলা বা ভুলের কারণে রোগীর ক্ষতি হলে সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, এমনকি নিবন্ধন বাতিল করতে পারে বিএমডিসি।
কিন্তু বিএমডিসিতে চিকিৎসাপ্রার্থীদের অভিযোগের পাহাড় জমলেও অভিযোগ নিষ্পত্তির হার একেবারেই হাতে গোনা। আর তাই এই প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুলের কত অভিযোগ জমা পড়েছে, সেই হিসাব প্রতিষ্ঠানে নেই। নানা অভিযোগের হিসাব রাখা হচ্ছে ২০০৪ সাল থেকে।
বিএমডিসির তথ্য বলছে, হিসাব রাখার পর থেকে ২৬৮টি লিখিত অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৪টি ঘটনার। বাকিগুলোর মধ্যে সংশ্লিষ্ট ৫০ চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট যাচাই চলছে, আর ২৮ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সম্প্রতি অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে দুই চিকিৎসককে চিঠি দিলেও উত্তর মেলেনি। গত ১৩ বছরে একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল ও ১২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে সন্তান প্রসব করতে এসে মারা যাওয়া মাহবুবা রহমান আঁখি ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লুকোচুরি, তথ্য প্রদানে অনীহা, অসহযোগিতাসহ নানা বিষয় সামনে এসেছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে রোগীর জীবনের নিরাপত্তা ও সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা নিয়ে।
আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন ২১ জুন সন্ধ্যায় দৈনিক বাংলাকে জানান, ময়নাতদন্তের পর স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে তিনি কুমিল্লায় চলে গিয়েছেন। নিজেও অসুস্থ। দু-এক দিনের ভেতরে তিনি ঢাকায় আসবেন এবং ডা. সংযুক্তা সাহার নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করবেন, অভিযোগ করবেন।
ইয়াকুব আলী বলেন, ‘বিচার হয়তো পাব না। কারণ এখানে বিচার খুব বেশি হয়েছে, এমন নজির নেই। তবে আমি বিচার চাইব। বিচার চাইব, কারণ আমার আর হারানোর কিছু নেই।’
২০১৬ সালের ৩ মে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজি) প্রকাশিত ‘মেডিকেল এরর: দ্য থার্ড লিডিং কজ অব ডেথ ইন দ্য ইউএস’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর আড়াই লাখ লোকের মৃত্যু হয় চিকিৎসায় ভুলের জন্য। সেখানে বলা হয়, চিকিৎসায় ভুলের কারণে মৃত্যুর বিষয়টি অনেক দেশেই স্বীকৃত না। আর স্বীকৃত না বলেই এই ভুল দূর করার কোনো উদ্যোগও সেসব দেশে নেই।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, মানবিক ভুল অনিবার্য। তবে চিকিৎসায় ভুল হলে প্রথম কাজ হচ্ছে ভুলটাকে দৃশ্যমান করা, যেন সেই ভুলের ক্ষতি কমাতে উদ্যোগ নেয়া যায়। ভুল হলে তার প্রতিকার কী হবে, তা হাতের কাছে রাখা দরকার। আর কিছু নীতি মেনে চলতে হবে, যেন ভুল কম হয়। এই তিন স্তরের কাজের জন্য চিকিৎসায় ভুলের নির্ভরযোগ্য উপাত্ত দরকার।
বিএমডিসিতে অভিযোগের পাহাড় জমলেও নিষ্পত্তি এমন কম কেন, প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, আইনের কিছু ত্রুটিকে দুষছেন। প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেও প্রতিকার মিলছে কম। এ জন্য রোগী সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন জরুরি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই-মাহবুব দৈনিক বাংলাকে বলেন, অভিযোগ দেয়া হলে অভিযোগকারী এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা চিকিৎসকদের চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে দুই পক্ষের হাজিরা দেয়ার হারই কম।
সেখানে সবকিছু ‘আন্ডার দ্য টেবিল’ কাজ হয়। তাহলে দৃশ্যমান নিষ্পত্তি কীভাবে হবে বলেও প্রশ্ন করেন অধ্যাপক ডা. রশীদ ই-মাহবুব।
এদিকে বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেন দায় চাপালেন প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার ওপর। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ আসছে অনেক। কিন্তু আমরা একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান। এখানে তদন্ত হতে সময় দরকার অনেক, কিন্তু গুরুত্ব দিয়েই সেগুলো দেখি আমরা।’
অভিযোগ অনেক রয়েছে স্বীকার করে চিকিৎসক নেতা অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা নিষ্পত্তি করছি না, বিষয়টি আসলে তা নয়। তবে এর দীর্ঘসূত্রতা অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, “পাঁচ সদস্যের এই বিচারিক কমিটি। তারা সবাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সবার সব সময় সময় মেলানো কঠিন। প্রতিদিন কোর্ট বসানো সম্ভব হয় না, মাসে দুই থেকে একবার। আমরা যদি আরও ঘন ঘন কোর্ট বসাতে পারতাম, তাহলে ‘ব্যাকলগ’টা কমত।”
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা