বিলকিস বেগম (৫৫) ঢাকায় সন্তানদের সঙ্গে থাকতেন। ঈদের আগে বরগুনার বেতাগী উপজেলার মোকামিয়া ইউনিয়নের মাছুয়াখালী গ্রামের বাড়িতে আসেন। বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন ভাড়াটিয়া এবং স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক আ. রহমান জুয়েল (৩৩)। তিনি সপরিবারেই ওই বাড়িতেই থাকছিলেন।
বিলকিস বাড়ি এসে ঘরদোর নোংরা দেখে জুয়েলকে বকাবকি করেন। এ নিয়ে দুজনের ঝগড়া হয়। জুয়েল বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ হন এবং তার ঘনিষ্ঠ দুজনের সঙ্গে আলাপ করেন। তাদের মধ্যে একজন জুয়েলকে পরামর্শ দেন, ওই নারীকে হত্যা করে বাড়িটি দখলে নিতে। জুয়েলকে ওই ব্যক্তি বলেন, বিলকিসের ছেলেরা ঢাকা থেকে এই বাড়িতে আসবেন না। মেরে ফেললে তিনিই সহায়-সম্পত্তির মালিক হবেন। জুয়েল সেই পরামর্শ ধরে ওই দুজনেরই সহায়তায় বিলকিসকে হত্যা করেন। এমনকি তারা চলে যাওয়ার পর তিনি মৃতদেহ ধর্ষণও করেন। পরে সাজান ডাকাতির নাটক। নিজেরাই খবর দেন বিলকিস বেগমের সন্তান-স্বজনদের।
উল্লেখযোগ্য কোনো ক্লু (আলামত) না থাকা সত্ত্বেও এই নারকীয় হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছে বরগুনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। শুক্রবার জেলা ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল ইসলাম খান দৈনিক বাংলাকে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডটির বিস্তারিত জানিয়েছেন।
তিনি জানান, গত ২৩ জুন রাতে ওই হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় ডাকাতির নাটক সাজিয়ে জুয়েল এলাকাবাসী ও বিলকিসের স্বজনদের কাছে দাবি করেন, তিনি ও তার পরিবার ঘুমিয়ে ছিলেন। তারা কিছুই জানেন না। পরে জুয়েলের স্ত্রীকে ডিবির কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এক পর্যায়ে তিনিই সব ঘটনা বলে দেন।
শহিদুল ইসলাম খান বলেন, বিলকিস বেগম ঈদ উদযাপন করার জন্য ঘটনার দুই দিন আগে ঢাকা থেকে গ্রামে আসেন। তার স্বামী আ. মান্নান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে চাকরিরত অবস্থায় ২০২০ সালে করোনায় মারা যান। তার দুই ছেলেও সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন। ছেলে ও তাদের স্ত্রী এবং নাতিরা ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে আসবেন বলে বাড়িঘর গোছাতে বিলকিস আগেই চলে আসেন।
বাড়ি এসে ঘর নোংরা দেখে ভাড়াটিয়া ও দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা জুয়েলকে (৩৩) বকাবকি করেন। এ নিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি ও ঝগড়া হয়। জুয়েল তখন জানান, তার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় বাড়িঘর নোংরা হয়েছে। পরে ঝগড়ার বিষয়টি জুয়েল তার ঘনিষ্ঠ নির্মাণশ্রমিক হিরুকে (৩৮) জানান। তাকে বলেন, ‘প্রতিবার ঢাকা থেকে এসে ঝগড়াঝাটি করবে, তা আর ভালো লাগে না।’ তখন হিরু বলেন, ‘ওপরে পাঠিয়ে দাও। মহিলা মরলে জমিজমা তোমার হয়ে যাবে। তার ছেলেরা ঢাকায় থাকে, ঢাকায় চাকরি করে। চাকরি ছেড়ে তারা আর জমিজমা খেতে গ্রামে আসবে না। এই জমিজমা তোমার হয়ে যাবে।’
ডিবির ওসি বলেন, হিরুর ওই পরামর্শে তখনই বিলকিস বেগমকে হত্যার পরিকল্পনা নেন জুয়েল। ছক কষেন, হত্যা শেষে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে বলে প্রচার করে দেবেন, যাতে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারেন। কিলিং মিশন সফল করতে তারা তাদের আরেক ঘনিষ্ঠ স্থানীয় মুদি দোকানদার মাসুদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। তাকেও মিশনে জড়িত করেন। কিন্তু ওই বাড়িতে ঢোকার আগে কেউ কাউকে মোবাইলে কল করা এড়িয়ে যান, এ সতর্কতা তারা নেন মোবাইল ট্র্যাকিং এড়াতে। তবে যোগাযোগের জন্য তারা বেছে নেন বিলকিস বেগমের বাড়ির উঠোনে থাকা টিউবওয়েল। সেটিতে কয়েকটি চাপ দিলে একে-অপরের উপস্থিতি সংকেত বোঝার সিদ্ধান্তে আসেন।
এরপর পরিকল্পনা অনুসারে ২৩ জুন রাতে জুয়েল তার অসুস্থ স্ত্রীকে জ্বরের ওষুধের পাশাপাশি লম্বা সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে আরেক ওষুধ খাইয়ে দেন এবং জোরে সিলিং ফ্যান ও চার্জার ফ্যান ছেড়ে দেন। মধ্যরাতে হিরু এসে টিউবওয়েলে জোরে জোরে কয়েকটি চাপ দিলে জুয়েল দরজা খুলে হিরুকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। বাইরে পাহারায় থাকেন মাসুদ। ঘরে ঢুকে জুয়েল বিলকিস বেগমের বুকের ওপরে উঠে গলাটিপে ধরেন আর হিরু পা চেপে ধরেন। এসময় ধস্তাধস্তির শব্দ যেন না হয় সেজন্য বিলকিস বেগমের মুখে তোয়ালে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা নিশ্চিত করেন।
ডিবির এই কর্মকর্তা জানান, জুয়েল ও হিরু কিলিং মিশন শেষে ঘরের মালপত্র তছনছ করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন। একই সঙ্গে জানালার গ্রিল কেটে মেঝেতে রাখেন, যেন সবাই মনে করে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ঘটনা শেষে জুয়েল বিলকিস বেগমের স্বর্ণালঙ্কার হিরুকে দিয়ে দেন। হিরু চলে যাওয়ার পর জুয়েল ঘরে ঢুকে বিলকিসের মৃতদেহকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ করার পর বিলকিসের মরদেহে আঘাত করেন, যেন সবাই মনে করে ডাকাতরা বিলকিসকে মারধর ও ধর্ষণ করেছে।
পরে জুয়েল এসে অসুস্থ স্ত্রীর পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল সাড়ে ৭টায় ঘুম থেকে উঠে জুয়েল তার স্ত্রী বিলকিস বেগমকে ডাকাডাকি করেন এবং হিরুকে ফোন দেন। হিরু এলে তারা প্রথমে বিলকিস বেগমের মেয়ে জামাই বেতাগী স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাকে তাকে খবর দেন। পরে ঢাকায় তার ছেলেদের খবর দেয়া হয়। সবাইকে বলা হয়, বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে এবং বিলকিস বেগমকে হত্যা করা হয়েছে।
শহিদুল ইসলাম খান বলেন, বরগুনা ডিবির ওপর ক্লুলেস এই হত্যা মামলা তদন্তের নির্দেশ এলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হই। জুয়েলের স্ত্রীর তথ্য ধরে জুয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনিও স্বীকারোক্তি দেন।
ডিবির ওসি জানান, হত্যা মামলায় জুয়েলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বরগুনা চিফ জুডিসিয়াল আদালতে সোপর্দ করা হয়। সেখানে ১৬৪ ধারায় তিনি জবানবন্দি দিলে আদালত জেলহাজতে পাঠান।
অন্যদিকে দুদিনের মাথায় ২৫ জুন রাতেই অভিযান চালিয়ে মামলার অন্যতম সহযোগী হিরুকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। হিরুর তথ্য মতে, ২৭ জুন রাতে অভিযান চালিয়ে মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাসুদের ট্রাংক থেকে বিলকিস বেগমের কানের দুল জব্দ করা হয়। হিরু ও মাসুদও চিফ জুডিসিয়াল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে তাদের জেলহাজতে পাঠান আদালত।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা