আমানউল্লাহ আমান
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আয়োজিত সংলাপে অংশ নেয়া দলগুলোকে ঘিরেই প্রাথমিকভাবে নির্বাচনের ছক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯ দলের মধ্যে বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। প্রাথমিকভাবে এই ৯টি দলকে ছকের বাইরে রাখলেও তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ধারণা ক্ষমতাসীন দলের।
তার পরও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ না নেয়া দলগুলোকে ছকের বাইরে রেখে বাকি ২৯টি দলকে মাথায় রেখে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দেশের মানুষের কাছে রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতরাও যাতে নির্বাচনে অংশ নেন সে বিষয়েও নজর আছে দলটির।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়া দলগুলো নির্বাচনমুখী বলে মনে করছি। বিএনপিসহ ৯টি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে তারা নির্বাচনেও অংশ নেবে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। ইভিএম ও কিছু কিছু বিষয়ে তাদের আপত্তি থাকলেও তারা নির্বাচনে অংশ নেবে।’
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিসহ আওয়ামী লীগের বিরোধী দলগুলো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়নি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দল ও জোট। যুক্তফ্রন্ট নাম নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র মনে করছে, সে ক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব থাকলেও আওয়ামী লীগের হাতে খেলার জন্য বি. চৌধুরী, তার নেতৃত্বাধীন দল ও জোট হতে পারে তাদের জন্য তুরুপের তাস।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আবদুল মান্নান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের এখনো ১ বছর আছে। আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে। আমরা চাই একটা সুষ্ঠু ভোট হোক। মানুষ তার ভোট যাকে খুশি তাকে দেবে। নির্বাচন কমিশন একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য অনেক অগ্রসর হয়েছে। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন করা উচিত। নির্বাচন না করলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা শূন্যতায় পড়ে যাবে। তখন গণতন্ত্র অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইভিএমটা আমরা সমর্থন করব না। ইভিএমের ওপর আমাদের আস্থা নেই। ইভিএমের ওপর একটা সন্দেহ থাকে, সেটা আমরা রাখতে চাই না।’
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে নির্বাচন বয়কট করার কারণেই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। এখন যদি এই সরকার, সেই সরকার এগুলো বলে নির্বাচন বয়কট করা হয় তা হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতির জায়গায় অবনতি হবে। ওইটা সঠিক পদক্ষেপ হবে না। যেভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, মানুষ ভোট দিতে পারবে এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে সেই পন্থায় নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। সবাইকে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত।’
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, গত নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল বিএনপি। ওই জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ায় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার রাজনৈতিক সুযোগ নেই। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। তাই আন্দোলনের নাম নিয়ে যতই রাজপথ গরম রাখার চেষ্টা করুক বিএনপির শেষ গন্তব্য নির্বাচন। দল ও দলীয় নেতা-কর্মীদের বাঁচাতেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।
দল বাঁচাতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে মন্তব্য করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টিসহ কিছু ইসলামি দল নির্বাচনে আসবে। বিএনপি না এলেও দেশের মানুষ রাজনীতিবিদ হিসেবে যাদের চেনেন তারা যদি নির্বাচনে অংশ নেন তাহলে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। আর তারা এলে তো নির্বাচন পুরোপুরি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কোনো পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হবে না বলে বিরোধীদের আশ্বস্ত করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো পুরোপুরি তৎপরতা শুরু হয়নি। রাজনৈতিক মাঠ পর্যবেক্ষণ করে একটি ছক প্রাথমিকভাবে দলীয় চিন্তায় আছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গী ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের ধরে রেখে রাজনীতির মাঠে নতুন মিত্রদের সঙ্গে হতে পারে সখ্য ও সমঝোতা। জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ স্বাভাবিকই আছে। জোটের বাইরে যেসব দল নির্বাচনে সঙ্গী হতে পারে তাদের সঙ্গেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে সম্প্রতি হতাশা প্রকাশ করেছেন জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। জাতীয় প্রেসক্লাবে দলটির আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে এলেন, কিন্তু মূল সমস্যাগুলোর কোনো আশাবাদী সমাধান দেখছি না।’
অন্যদিকে ১৪ দলকে সক্রিয়, দৃশ্যমান ও সম্প্রসারণ করার দাবি তুলে জোটের অপর শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘বিএনপি-জামায়াত-তালেবানি শক্তির পুনরুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য যে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে, অস্বাভাবিক-অসাংবিধানিক সরকার আনার যে অপচেষ্টা চলছে, তা প্রতিহত করতে হলে আওয়ামী লীগকে একলা চলো নীতি পরিহার করতে হবে। ১৪ দলকে কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত সক্রিয়, দৃশ্যমান ও অপরাপর অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শক্তিকে ১৪ দলের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ১৪ দলের শরিক নেতারা মাঝেমধ্যে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে যাবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের ভাষ্য মতে, সরকারের সুযোগ-সুবিধার ভাগবাঁটোয়ারার পাশাপাশি রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য জোটের শরিক নেতারা মাঝেমধ্যেই সরকারের সমালোচনা করছেন। এটা অনেকটা অভিমানও বলা যেতে পারে।’
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, রাজনীতির মাঠে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোটের পরিধি বৃদ্ধি বা সমঝোতার দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড প্রকাশ না পেলেও অন্তরালে এ সব কাজ চলছে। নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এমন দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মহল, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর আলাদাভাবে যোগাযোগ আছে। যদিও সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থার কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগকে একলা ফেলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার দিকে ওই সব রাজনৈতিক দল যাবে না বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিতে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। চলতি বছরের জুনে অনুষ্ঠিত ওই সংলাপ বর্জন করে বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয় সংলাপে। পরে সংলাপে অংশ নেয়ার জন্য সময় চেয়ে ইসিকে চিঠি দেয় দুটি রাজনৈতিক দল।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি সংলাপে অংশ নেয়নি।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা