আপডেট : ৩ জুলাই, ২০২৩ ০৯:৩১
অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে লাখ টাকার বাণিজ্য
প্রতিনিধি, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)

অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে লাখ টাকার বাণিজ্য

মৌলভীবাজারে বাড়ছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের সংখ্যা। বিদ্যুতের প্রধান সঞ্চালন লাইন থেকে অবৈধ সংযোগ ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। এ ছাড়া রেলওয়ের বিদ্যুৎ লাইন থেকেও দেয়া হচ্ছে অবৈধ সংযোগ। এসব সংযোগের বাড়তি বিল বহন করতে হচ্ছে রেলওয়েকেই। অথচ অবৈধ সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রেলস্টেশনের আশপাশের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটগুলোতে বাতি, পাখা, এলইডি টিভি, ফ্রিজ এমনকি রান্নার হিটারও চলছে অবৈধ সংযোগে। এসব বাসা ও দোকানপাটে অবাধে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হলেও মিটার না থাকায় তাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ জানারও কোনো উপায় নেই। আর মাস গেলে তাদের বিল দিতে হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রেলের কর্মচারীরা নিজেদের নামে বিদ্যুতের মিটার নিয়ে একাধিক ভাড়াটিয়াকে অবৈধভাবে সংযোগ দেন। এভাবে তারা বছরের পর বছর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীরাও এর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া সিলেট-আখাউড়া রেলওয়ের কয়েকটি স্টেশন বন্ধ থাকায় সেখানকার জায়গা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাড়া দিয়েছেন বহিরাগতদের। এসব জায়গা থেকেও অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে তারা আদায় করছেন লাখ লাখ টাকা। আর অবৈধ সংযোগের জন্য বড় অঙ্ক গুনতে হচ্ছে রেলওয়েকে।

কুলাউড়া, শমশেরনগর ও শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক কোয়ার্টার (বাসা), মার্কেট, ভাসমান দোকান, ঝুপড়ি ঘর ও কলোনিসহ ছোট-বড় হাজারও স্থাপনার প্রায় প্রতিটিতেই রয়েছে লাইট, ফ্যান, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক আয়রন, বৈদ্যুতিক চুল্লি ও পানি তোলার মোটর। চলছে হোটেলের ব্যবসাও। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে এসব মার্কেট ও বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে রেল কর্তৃপক্ষ। অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী কয়েকজন জানান, মাস শেষে বিল দেন ১ হাজার ৫০০ টাকা।

শমশেরনগর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবৈধ এসব সংযোগের সঙ্গে রেলওয়ে ও বিদ্যুৎ অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলেই অবৈধ সংযোগ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী বলেন, রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব ইউনিট নামে-বেনামে বরাদ্দ নিয়ে বহিরাগতদের ভাড়া দিচ্ছেন। এর ফলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা গচ্চা যাচ্ছে।

কুলাউড়া পৌর তালামীযের সাবেক সভাপতি আবদুল মুবিন বলেন, রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (সিলেট-আখাউড়া রেলওয়ে জংশন) জুয়েল হোসেনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, তারা এই কাজ করছে। কুলাউড়া, শমশেরনগর ও শ্রীমঙ্গল ছাড়াও সিলেট-আখাউড়া রেলপথের বিভিন্ন স্টেশনে তার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে।

এর আগে জুয়েল হোসেনের বিরুদ্ধে সরকারি উন্নয়নের তথ্য দিতে টালবাহানাসহ কুলাউড়া জংশন স্টেশনে যোগদানের পর থেকেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অভিযোগ ওঠে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, রেলে যোগ দিয়েই বড় একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন জুয়েল। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই তিনি অবৈধ সংযোগ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করেও সিলেট-আখাউড়া রেলওয়ে জংশন মৌলভীবাজার এরিয়ার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (কার্য) মো. জুয়েল হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে এসএমএস দিয়েও সাড়া মেলেনি।

জানতে চাইলে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) রথিশ পাল জানান, কুলাউড়া রেলস্টেশনে দেড় শতাধিক বৈধ মিটার রয়েছে। মাঝেমধ্যে স্টেশনে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। জুন মাসেও কুলাউড়া রেলস্টেশনে ১০টির মতো অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। স্টেশনে অবৈধ বসবাসকারী রোধ করা গেলে এ সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে শমশেরনগর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার উত্তম কুমারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে শ্রীমঙ্গলের মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অবৈধ সংযোগের বিষয়টি তার জানা নেই। ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী জুয়েলের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নেয়ার কথা বলেই তিনি ফোন কেটে দেন।

কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. রোমান আহমদ বলেন, একটি মিটার থেকে একাধিক সংযোগ দেয়া হলে তা সরকারের ক্ষতি। এটি রেলওয়ের নিয়ম-বহির্ভূত। স্টেশনে অবৈধ মিটার রয়েছে, এ রকম তথ্য পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কুলাউড়া পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সরকারের ক্ষতি হোক, এমন কিছুই আমরা চাই না। রেলস্টেশনে অবৈধ সংযোগের তথ্য পাওয়া গেলে পৌর কর্তৃপক্ষ রেলওয়ের পাশে থাকবে।’

এ বিষয়ে পিডিবি সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, ‘যারাই অবৈধ্যভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। রেলওয়েসংলগ্ন আশপাশের দোকানপাট বা বসতঘরগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলে সেগুলোও বিচ্ছিন্ন করা হবে।’