জাকিয়া আহমেদ
চিকিৎসায় যেসব ওষুধ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়, সেগুলোর দামের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেরাই দাম নির্ধারণ করে ঔষধ প্রশাসনকে দামের ঘোষণা দিয়ে দেয়। সেখানে প্রশাসনের করণীয় কিছু থাকে না।
অন্যদিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের’ তালিকায় যে ১১৭টি ওষুধ আছে, সেগুলোর ব্যবহার তেমন নেই বললে চলে। অথচ কম ব্যবহারের এসব ওষুধের দাম বাড়াতে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়।
১৯৮২ সালের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় কৃমির ওষুধ হিসেবে ছিল পাইপ্যারাজিন সাইট্রেট। কিন্তু পরের দুটি ওষুধ নীতির তালিকায় পাইপ্যারাজিন সাইট্রেটের নাম নেই। আর কৃমির ওষুধ হিসেবে পরে অ্যালভ্যানডাজলসহ আরও কয়েক ধাপ পরের ওষুধ বাজারে এখন।
১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে ১৫০টি ওষুধের তালিকা করা হয়েছিল ‘অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ’ বা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ হিসেবে। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে ১১৭টিকে এই তালিকায় রাখা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যাবশ্যকীয় তালিকার যে ১১৭টি ওষুধ রয়েছে, তার মধ্যে এখন রোগীদের ব্যবস্থাপনাপত্রে থাকা ওষুধ থাকে খুবই কম। বরং মানুষ এখন যেসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, সেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা বা ক্যানসারের মতো ক্রনিক অসুখগুলোতে যেসব ওষুধ ব্যবহার হয়, সেগুলো সরকারের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় নেই। তাই সরকার এসব ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এসব ওষুধের বেশির ভাগ দামই কোম্পানি নির্ধারণ করে থাকে।
তারা বলছেন, ১১৭টির যে তালিকা সেটা এখন ইতিহাস, তার দাম নিয়ে কথা বলার যৌক্তিকতাই এখন আর নেই। আর এখন যে ওষুধ বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে, সেসব ওষুধ সরকারের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় নেই, তাই এর দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, দাম নির্ধারণ করছে ওষুধ কোম্পানি। তাই অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করতে হবে, সেই তালিকাবদ্ধ ওষুধের দাম সরকারকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ওষুধ কোম্পানির ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না।
একাধিক ওষুধ বিশেষজ্ঞ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ১৯৮২ সালে ওষুধ নীতি হওয়ার পর ২০০৫ ও ২০১৬ সালে ওষুধ নীতি হয়েছে। কিন্তু দেশ চলছে সেই ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেই। ১৯৮২ সালের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের যে তালিকা করা হয়, সেই তালিকার অনেক ওষুধই এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না, অনেক কোম্পানি তৈরিও করে না। চিকিৎসকরা সেসব ওষুধ কেন লিখবেন, এই প্রশ্নও করেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে সব অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা থাকার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্য সুযোগ-সুবিধা নিলেও সর্বশেষ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করবে না- এটা হয় না মন্তব্য করে আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্তাবলির কিছু মানি, কিছু মানি না, এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব শর্ত মানতে হবে, নয়তো কোনোটাই মানা যাবে না। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাক্ষরকারী হিসেবে তার শর্ত মানা বাধ্যতামূলক।’
তিনি বলেন, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পরিবর্তন হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষের অসুখের ধরন এবং প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বর্তমান সময়ে বাজারের অনেক ওষুধই নতুন জেনারেশনের। এসব ওষুধের দাম সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ওষুধ খেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার দৈনিক বাংলাকে বলেন, সরকারের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকার অনেক ওষুধই এখন আর কাজ করছে না, এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি কোম্পানিগুলো তৈরিও করছে না।
সেই সঙ্গে ক্রনিক যেসব ওষুধ যেমন ডায়াবেটিস, ‘উচ্চরক্তচাপ, কিডনি জটিলতার মতো অসুখগুলোর চিকিৎসা দীর্ঘদিন ধরে হয় সেসব ওষুধের ওষুধের দাম নিয়ে ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি।’
দেশে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয় ওষুধ কিনতে গিয়ে। এর মধ্যে বিষফোঁড়ার মতো হয়ে গলায় বিঁধে প্রতিনিয়তই ওষুধের দাম বৃদ্ধি। নিম্নবিত্ত থেকে অনেকেই ওষুধ খাবেন, নাকি তিনবেলা ভাত খাবেন, সে লটারিতে জীবনের ছক সাজাতে বাধ্য হন।
রাজধানীর পরীবাগে রাস্তার ধারের চায়ের দোকানি মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী, বৃদ্ধ মা আর দুই সন্তান নিয়ে পাঁচজনের সংসার। ২০১০ সাল থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, পরে যোগ হয় কিডনিজনিত অসুস্থতা। কিছুদিন আগ পর্যন্ত প্রতি মাসে কেবল ওষুধের পেছনে খরচ হতো ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার মতো। কিন্তু কয়েক দিন আগে ওষুধের দোকানে গিয়ে সব ওষুধ কিনতে গিয়ে হোঁচট খান মোহাম্মদ আলী। দাম আসে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা।
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় ক্ষোভ তার। সংসার চালাবেন কীভাবে আর ওষুধই কিনবেন কীভাবে, প্রশ্ন মোহাম্মদ আলীর। সেই সঙ্গে বৃদ্ধ মায়ের অসুস্থতায় আরও লম্বা হয় ওষুধের ফর্দটিও।
রাজধানীর শাহবাগ, মগবাজার এলাকার একাধিক ফার্মেসিতে কথা বলে জানা গেছে, গেল দুই মাসে ওষুধের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ। সবচেয়েও বিস্ময়কর হলো, দাম বাড়ার ঘোষণাতেই বেশি দামে বিক্রি হয় গ্যাস্ট্রিক, হৃদ্রোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ সব ধরনের ওষুধের দাম।
একাধিক গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, দেশে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশই ওষুধের পেছনে। আর বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজারে সরকারি ব্যয় মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৯৫ শতাংশই যায় মানুষের পকেট থেকে।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, সম্প্রতি যে ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বেড়েছে, সেগুলো মানুষ নিত্য ব্যবহার করে। পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ দীর্ঘমেয়াদি অসুখের ওষুধের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধের ব্যয়ের বিষয়টি যদি সরকারের নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে থাকত, সরকারি হাসপাতালগুলো যদি নিজস্ব ইডিসিএলে (অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি) উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে পারত, তাহলে এই মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব ফেলত না। রাষ্ট্র উৎপাদক কোম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারত, যেটা এখন সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘জরুরি ওষুধের যে তালিকা রযেছে, সেখানে থাকা ওষুধগুলো চিকিৎসকরা হয়তো লেখেন ব্যবস্থাপত্রের শেষের দিকে। কিন্তু তালিকার ওপরের দিকে যে ওষুধগুলো দেয়া হয়, সেগুলোর কোনো তালিকাই নেই, দামের ক্ষেত্রেও সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।’
যক্ষ্মা, ক্যানসার, উচ্চরক্তচাপ, হেপাটাইটিস, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগে দেশের ৬৭ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত। এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর ওষুধ খেতে হয় প্রতিদিন, সারা বছর, কিন্তু এসব ওষুধের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, আলোচনাতেও নেই, বলেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।
ওষুধের বাজারে রাষ্ট্রের যে অংশগ্রহণ, এটা খুবই নেগলেজিবল (নগণ্য), বলেন তিনি।
অথচ ওষুধের বাজারে রাষ্ট্র বা সরকারের অংশগ্রহণ যদি বেশি হতো, তাহলে এই যথেচ্ছ মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ‘বার্গেইন’ করতে পারত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফিরোজ আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, যেসব ওষুধের দাম সরকারনির্ধারিত, কোম্পানিগুলো সেগুলো তৈরি করতে ইচ্ছুক নয়। আবার যেসব ওষুধের দাম কম, সেগুলো তারা তৈরি করছে না। বরং এর বিপরীতে যেসব ওষুধের দাম অনেক বেশি, সেগুলো বাজারে ভর্তি। অথচ এগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। বাজারে কন্ট্রোল নেই, কন্ট্রোল তো করার কথা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। তারা কেন করতে পারছে না?
অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় থাকা ওষুধের দাম নিয়ে বলতে গিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সরকার যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে না, সেসব ওষুধের দাম কোম্পানি ঠিক করে দেয় আমাদের অনুমোদন নিয়ে।’ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাই ঠিক নেই, এমন প্রশ্ন করলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কল কেটে দেন।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা