আপডেট : ২ অক্টোবর, ২০২২ ০৯:০৮
১৬ কিমিতে ১৬ অবৈধ লেভেল ক্রসিং, ৩ বছরে ৩৭ প্রাণহানি

১৬ কিমিতে ১৬ অবৈধ লেভেল ক্রসিং, ৩ বছরে ৩৭ প্রাণহানি

গেট ও গেটম্যান ছাড়া অবৈধ লেভেল ক্রসিং দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে যানবাহন ও মানুষজন। ছবি: দৈনিক বাংলা

বিল্লাল হোসাইন, নারায়ণগঞ্জ

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের চেয়ে অবৈধের সংখ্যাই বেশি। আর ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ এসব লেভেল ক্রসিং দিয়ে প্রতিনিয়ত যানবাহন ও লোকজন পারাপার হচ্ছেন। ফলে সেখানে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। গত ৩ বছরে এই রেলপথে অন্তত ৩৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে বৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১২টি। এর বাইরে আরও ৮টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, অবৈধ এসব ক্রসিংয়ের সংখ্যা সরকারি হিসাবের অন্তত দ্বিগুণ।

স্থানীয়রা জানান, এ রেলপথে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া বালুর মাঠ, গলাচিপা, উকিলপাড়া, ইসদাইর, ফতুল্লা রেললাইন, পূর্ব ইসদাইর, পাগলা নন্দলালপুর, কোতালেরবাগ ও দাপা ইদ্রাকপুরসহ ১৬টি স্থানে অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব ক্রসিংয়ে রেলওয়ের কোনো নিরাপত্তা প্রহরী বা গেটম্যান নেই। কয়েকটি লেভেল ক্রসিংয়ে বাঁশের গেট বানানো হলেও অধিকাংশই রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। এসব ক্রসিং দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন ও অটোরিকশা চলাচল করে। অনেক সময় ট্রেন আসতে দেখে আশপাশের লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি করে দ্রুত যানবাহন পারাপার করে।

নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সব বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে গেট ও গেটম্যান আছে। তারা পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো আমাদের (রেল কর্তৃপক্ষ) নয়। সেগুলো স্থানীয়রাই তৈরি করেছেন। সেখান দিয়ে ছোট-বড় যানবাহন ও স্থানীয় লোকজন মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে নিজ দায়িত্বে চলাচল করেন। সেগুলোতে আমাদের কোনো গেট বা গেটম্যান নেই।’

অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘রেলওয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার সেগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধও করে দেয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই স্থানীয়রা আবার সেগুলো চালু করেন।’

রেলওয়ের এই কর্মকর্তা জানান, চাষাঢ়া থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত দুটি অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে। অবৈধ গেটগুলো রেলওয়ের পরামর্শ ছাড়াই করা হয়েছে। এখানে লাইনের দুই পাশে অনেক অবৈধ স্থাপনা ও বাজার আছে। সেগুলোও অনেকবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। রেলওয়ে লাইনের দুই পাশে সব সময়ই ১৪৪ ধারা জারি থাকে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রেললাইনের ওপর দিয়ে যত্রতত্র সড়ক তৈরি করে অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়ে যাতায়াত করেন। আর এ কারণেই এ রুটে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

অবৈধ এসব লেভেল ক্রসিংয়ের জন্য এ রেলপথে গত কয়েক বছরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা মোখলেছুর জানান, ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়েছেন ১৩ জন। পরের বছর একইভাবে আরও ১৬ জন নিহত হন। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৮ জন। তবে গেণ্ডারিয়া থেকে রাজধানীর কমলাপুর পর্যন্ত রেলপথের দুর্ঘটনার কোনো হিসাব নেই নারায়ণগঞ্জ রেল পুলিশ ফাঁড়িতে। এ ছাড়া ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যও রাখেনি পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসকে ট্রেন ধাক্কা দিলে শিশুসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ১০ জন। একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি পাগলা নন্দলালপুর এলাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ঢাকাগামী একটি ট্রেন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্পের সেনাবাহিনীর ভাড়া করা একটি নোয়া মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে ৩০০ গজ দূরে নিয়ে ফেলে। এ ঘটনায় মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন চালক।

এর আগে, ২০১৪ সালের ২২ জুন রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পাগলা-রসুলপুর সড়কে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ পারাপার হতে গিয়ে ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী লেগুনা-জিপের সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হন, আহত হন আরও ১০ যাত্রী। এরপর ২০১৯ সালের ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা এলাকায় রেলপথের অবৈধ লেভেল ক্রসিং পারাপারের সময় মাইক্রোবাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। ট্রেনের গতি কম থাকায় সে সময় কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

রেলপথকে নিরাপদ রাখতে অবৈধ সব লেভেল ক্রসিং বৈধ করা উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল। তিনি বলেন, ‘গুরুত্ব বিবেচনায় গেট ও গেটম্যান দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে থাকা গেটম্যানরা যেন দায়িত্বে অবহেলা করতে না পারে, সে জন্য কর্তৃপক্ষের নজর বাড়ানো উচিত। কারণ তাদের অবহেলার কারণে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।’