আপডেট : ৯ জুলাই, ২০২৩ ০০:০৩
ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কোনো সতর্কবার্তাই আমলে নেয়নি কেউ
জাকিয়া আহমেদ

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কোনো সতর্কবার্তাই আমলে নেয়নি কেউ

ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে নৌকায় মশারি টানিয়ে ঘুমাচ্ছেন মাঝিরা। ছবিটি রাজধানীর বাবুবাজার সেতুসংলগ্ন এলাকা থেকে শনিবার ভোরে তোলা। ছবি: সৈয়দ মাহামুদুর রহমান

সেগুনবাগিচার একটি বহুতল ভবন। সেখানে এক পরিবারের পাঁচ সদস্যের সংসার। এই পরিবারের পাঁচজনই বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত। গৃহকর্ত্রী মাসুমা মায়মুরের জ্বর হয় গত ৩ জুলাই। পরের দিন তার ১৫ বছরের ছেলে সামিন, ১২ বছরের ছেলে রামিন, সামিন-রামিনের বাবা কাজী মায়মুর হোসেন আর মাসুমা মায়মুরের মা ৭২ বছরের সৈয়দা সকিনা বেগম জ্বরে আক্রান্ত হন। পরীক্ষার পর তাদের সবারই ডেঙ্গু ধরা পড়ে।

বর্তমানে কেবল সৈয়দা সকিনা বেগম ছাড়া কারও জ্বর নেই। সামিন আর রামিনের কাশি রয়েছে। আজ (রোববার) আবার তারা পরীক্ষা করাবেন। ঘরের সবার এ অবস্থায় মাসুমা মায়মুরের দিশেহারা অবস্থা। বিশেষ করে ৭২ বয়সী মায়ের জন্য চিন্তাটা একটু বেশি। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ির চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এরপরও আমরা সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হলাম।’

মাসুমা মায়মুরের মতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটছে প্রতিটি ঢাকাবাসীর। বিশেষ করে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যখন ঘোষণা দিয়ে জানান দেয়, পুরো ঢাকা ঝুঁকিতে, আমাদের সবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে, তখন সে উদ্বেগ ভয়ংকর আকার ধারণ করে।

এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের একদিনে সর্বোচ্চ রোগী সংখ্যার নতুন রেকর্ড হয়েছে দেশে। এত রোগী এর আগে চলতি বছরে আর হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। আর এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও দুজনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শনিবার জানিয়েছে ২৪ ঘণ্টায় (৭ জুলাই সকাল ৮টা থেকে ৮ জুলাই সকাল ৮টা) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮২০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যা চলতি বছরে এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নতুন রেকর্ড। এর আগে গত ৪ জুলাই এক দিনে ৬৭৮ জন রোগী ভর্তির তথ্য দিয়েছিল অধিদপ্তর।

অধিদপ্তর জানাচ্ছে, নতুন ভর্তি হওয়া ৮২০ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬০৩ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ২১৭ জন।

বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২ হাজার ৫০২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ৭৭৩ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রয়েছেন ৭২৯ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ১১৮ জন। তাদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ হাজার ৫৪৯ জন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে দুজনের। তাদের নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হলো ৬৭ জনের।

দেশে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। তখন থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বর্ষা শুরু হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে থাকবে। সে হিসাবকে সত্যি প্রমাণ করে জুন ছাড়িয়ে জুলাইতে এসে ডেঙ্গু তার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মাসের প্রথম আট দিনে (৮ জুলাই সকাল ৮টা) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ১৪০ জন, আর এ মাসে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। যেখানে পুরো জুনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৬ জন আর মৃত্যু হয়েছিল ৩৪ জনের।

কোনো সতর্কবার্তাই আমলে নেয়া হয়নি

মে মাসের শেষ দিক থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। হাসপাতালগুলোতে বাড়তে থাকে বেডের সংখ্যা। সে সময় থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা গোটা স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার এডিস নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। কিন্তু জবাবে দুই নগরভবন থেকে সেভাবে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং দায় চাপানো হয়েছে।

গত ৫ জুলাই হাতিরঝিলে পানি নিষ্কাশন যন্ত্র পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ডেঙ্গু নির্মূল কেউ করতে পারবে না। কোনো দেশ করতে পারেনি। আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আপনারা যদি উন্নত দেশের সঙ্গে তথ্য ও পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন অন্যান্য দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি। যদিও আমাদের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

বরং তিনি চিকিৎসা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা সেবার মান পরিধি আরও বৃদ্ধি করতে হবে।

‘একজন রোগী যেন শঙ্কাজনক অবস্থায় না যায়, এ জন্য প্রাক (আগের) যে কার্যক্রমগুলো… চিকিৎসা সেবা, এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে মৃত্যুর হার কমাতে পারব।’

তবে সিটি করপোরেশন ওষুধ ছিটানোর কাজ কতটুকু করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডের চায়ের দোকানি মো. ইলিয়াস দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সাংবাদিকরা নিউজ লিখে কী হবে? নিউজে তো আর মশা মরবে না, মশা মরবে ওষুধে। কিন্তু একদিনও তো এখানে ওষুধ ছিটাতে দেখলাম না।’

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার ওষুধ ছিটানো কার্যক্রমকে এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। এক দিনের জন্যও ওষুধ ছিটানো বন্ধ করা যাবে না।

পুরো ঢাকায় একসঙ্গে যুগপৎ কার্যক্রম চান বিশেষজ্ঞরা

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সামনে আরও রোগী বাড়বে, বাড়বে মৃত্যুও। গত ২৩ বছর ধরে দেশে ডেঙ্গু রয়েছে। অনেকে জানেনও না, তারা এর আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।’

যারাই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অবস্থাই খারাপ হচ্ছে। কারণ, প্রথমবার ভাইরাসের যে ধরন (সেরোটাইপ) দিয়ে আক্রান্ত হয়, দ্বিতীয়বার সেটা হয় না। অন্য ধরন দিয়ে আক্রান্ত হয়। এই দুবারে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তারাই ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুও হচ্ছে বেশি…। দ্বিতীয়বারেই সমস্যা হচ্ছে বেশি।’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘জরুরি ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এখন পুরো দেশই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। প্রতিটি গ্রামে এবং ওয়ার্ডে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে স্বাস্থ্যবিভাগকে। জনস্বাস্থ্য কীটতত্ত্ববিদ তৈরি করতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারা মশার প্রজননকেন্দ্রগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করবেন।

আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে এখন জরুরি ভিত্তিতে, নয়তো সামনে আরও কঠিন সময় দেখতে হবে আমাদের।’

মশার ওষুধ ছিটানো নিয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে এখন প্রতিদিন একই সঙ্গে ওষুধ ছিটাতে হবে। নয়তো এক জায়গায় ওষুধ ছিটানো হলে অন্য জায়গায় মশা উড়ে যাবে। কিন্তু একই সঙ্গে যদি পুরো ঢাকা শহরে ওষুধ ছিটানো যায়, তাহলেই কেবল মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা যাবে। তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশনকে স্বেচ্ছাসেবী এবং নাগরিকদের নিয়ে একটি ‘যুগপৎ কার্যক্রম’ নিতে হবে এজন্য। একেক দিন একেক জায়গায় ওষুধ ছিটিয়ে ফলপ্রসূ কিছু আশা করা যাবে না।”

এডিস মশা নিয়ে কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতির ভয়ংকর অবনতি হচ্ছে। সপ্তাহের ছুটির দিনেও এখন মশক নিধন কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। এটা হতে হবে সমন্বিতভাবে-এই পদক্ষেপ নেয়া এখন অত্যন্ত জরুরি এবং সময়ের দাবি। বর্তমানে যে অবস্থা তাতে প্রতিদিন মশকনিধন কার্যক্রম চালাতে হবে, নয়তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না। কারণ ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেছে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মানা হয়নি

২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে মধ্যবর্তী পরিকল্পনা দিয়েছিলেন সরকারকে। সেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কোন মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করবে, সেটাও বলা হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে কাজ হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সে পরামর্শ নিয়ে কাজ হয়নি, সমন্বিত যে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল সেটাও কিছু হয়নি।’

‘বর্তমানে যখন ডেঙ্গু বাড়ে তখন এডহক ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করা হয়। কিন্তু এটা কার্যকরী না। যদি কার্যকরী হতো তাহলে তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসত’, যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গুর ২৩ বছর গেছে। শুরুতে ঢাকায় ছিল, তখন বলা হতো এটা শহর বা নগরের রোগ। সেটা নিয়ন্ত্রন তো হয়ই নি, পুরো দেশে ছড়িয়েছে। এটা ছিল মহানগরীর, সেটা এখন দেশজুড়ে।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি ১৯ দফা সুপারিশ করেছিলেন। কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, কীটতাত্ত্বিক পরীক্ষাগার বাড়াতে হবে, কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণসহ আরও কিছু সুপারিশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনোটাই হয়নি।

এখন উচিত হলো, জরুরিভিত্তিতে জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করে বাজেট বরাদ্দ, লোকবল, যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ সবকিছু করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আর তা যদি না হয় তাহলে কয়েক বছর পরপরই জনস্বাস্থ্য সমস্যা হবে।’