১৯৭১ সালে নেত্রকোনার দুর্গাপুর কৃষাণ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কলেজ থেকে পালিয়ে জন্মস্থান ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ঢাকুয়া ইউনিয়নের ঢাকুয়া গ্রামে এসে এলাকার ৫০-৬০ জন যুবক ও ছাত্রদের একত্রিত করেন। এরপর তাদের নিয়ে ভারতের ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন তিনি। বলছিলাম জামাল উদ্দিনের কথা। ঢাকুয়া গ্রামের মৃত আফসর উদ্দিনের ছেলে তিনি।
জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়ের পতাকা, স্বাধীন দেশের মানচিত্র। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলল না তার!
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো জ্বল জ্বল করে চোখে ভাসে জামাল উদ্দিনের। তিনি দৈনিক বাংলাকে জানান, ‘ভারতের তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ৪ নম্বর উইংয়ে ২৭ দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ জেএল কোর্স সম্পন্ন করেছিলেন। প্রশিক্ষণকালীন উইং কমান্ডার ছিলেন মো. আব্দুর রহিম, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মো. আব্দুল রহমান। তিনি (জামাল উদ্দিন) প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং একটি এলএমজি সংগ্রহ করেছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পের পাশে কন্যাডুবি এফএফ ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এরপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
স্মৃতির খাতা খুলে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সরচাপুর ব্রিজের কাছে পাক বাহিনীর মর্টার শেলের একটি টুকরা আমার ডান হাতে বিদ্ধ হয়। তখন আমি আমার কোম্পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমার পেছন থেকে হালিম কোম্পানি কমান্ডার আমাকে সাহায্য করেন এবং আমি হালিম কোম্পানিতে যোগ দিয়ে হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যে কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সব যুদ্ধেই অংশ নিই। যখন ১১ নম্বর সেক্টর ক্লোজ করা হয়, তখন আমাদের বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন অধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (এম এ জি ওসমানী) স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেট দেয়া হয়, যা আমার মূল প্রমাণপত্র।’
আক্ষেপ করে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘১৯৯০ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত দলিলে আমার নাম না থাকায় আমি হতাশ হই। জেলা কল্যাণ ট্রাস্টের দলিলে উল্লেখ করা আছে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে প্রাপ্ত দলিলের মধ্য থেকে ১ হাজার ৭৬টি দলিল বিনষ্ট বা অস্পষ্ট থাকায় সর্বমোট ১ হাজার ১২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটিতে আমাকে ডাকা হয়। এ সময় জামুকার কেন্দ্রীয় কমিটির একজন, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন, থানা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একজন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সাত সদস্যের কমিটির সবাই উপস্থিত ছিলেন। যাচাই-বাছাই শেষে উপজেলার ১০ জনকে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে আমার নামটি ক্রমিক নম্বর ১-এ রাখা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম তোলা হয়নি।’
একই উপজেলার কামারগাঁও ইউনিয়নের কালিখা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি সিদ্দিক বলেন, ‘আমি ও জামাল উদ্দিন হালিম কোম্পানিতে ছিলাম। একসঙ্গে তুরাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ভারতের তালিকায় আমার নাম আসার কারণে আমি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু ভারতের তালিকায় অনেকের নাম আসেনি, ফলে জামাল উদ্দিনের মতো অনেকে এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি।’
একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুসলেম উদ্দিন সরকার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তারাকান্দা উপজেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, ‘তুরা ক্যাম্পে আমি প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম৷ আমার সঙ্গে জামাল উদ্দিন ছিলেন হালিম কোম্পানিতে। জামাল উদ্দিন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তবুও তাকে এই শেষ বয়সে স্বীকৃতির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এই যুদ্ধের শেষ কোথায়।’
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডের সদস্য সচিব কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করেও তালিকায় নাম না তুলতে পারলে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) উদ্যোগে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় ওঠানো প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জামুকার পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) যুগ্মসচিব মো. শাহ আলম সরদার বলেন, ‘জামাল উদ্দিনসহ আরও অনেকেরই জেনারেল এম এ জি ওসমানী স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট ছিল। কিন্তু যথাসময়ে অনলাইনে আবেদন না করায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠেনি।’
তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে জামাল উদ্দিনের সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না। আগামী সপ্তাহে জামুকায় এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলবেন। সব কাগজপত্র দেখে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা