আপডেট : ৩ অক্টোবর, ২০২২ ০৮:১৫
আমারে যেন না করি প্রচার

আমারে যেন না করি প্রচার

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

তোয়াব খানের মৃত্যুতে এ দেশের সাংবাদিকতা জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। জীবদ্দশায় নিজেকে কিংবদন্তির জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন আমাদের প্রিয় তোয়াব ভাই। প্রায় সত্তর বছরের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি ছিলেন নানা স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।

সদ্য প্রয়াত তোয়াব খানের চেহারাটা মনে এলেই আমার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৩১৩ বঙ্গাব্দে রচিত ‘আমার মাথা নত করে দাও হে প্রভু’ কবিতার ‘আমারে যেন না করি প্রচার’-পঙ্‌ক্তিটি বারবার স্মরণে আসছে। বাংলা সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মওলানা আকরম খাঁর পরিবারে জন্ম নেয়া তোয়াব ভাই ১৯৫৩ সালে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। এরপর থেকে তিনি বহু সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে তার উপস্থাপিত ‘পিন্ডির প্রলাপ’ জনমানসে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে সঞ্জীবিত তোয়াব খান তাই মৃত্যুর অল্প কয়েক দিন আগে নব উদ্যোগে প্রকাশিত ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের সময় শর্ত দিয়েছিলেন, দৈনিকটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হতে হবে।

এর আগে ১৯৯৩ সালে জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে তার ভূমিকা আমাদের মনে আছে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার দৃঢ়তা সে সময় দৈনিকটির পাতায় পাতায় প্রতিফলিত হতো। প্রায় ৮৮ বছর বয়সেও তিনি মানসিক এবং শারীরিক স্থিতাবস্থা বজায় রেখে একটি নতুন দৈনিক পরিচালনার কঠিন কাজে কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, সেই কাহিনিটি ইতিমধ্যে তার সেখানকার সহকর্মীদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত লেখা বা সংবাদ থেকে জানা যায়। তবে তার এই অসাধারণ কর্মনৈপুণ্য অনেক আগে থেকেই সুবিদিত। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় রূপান্তরের ঐতিহাসিক মুহূর্তে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আবার তাই যখন নতুন আঙ্গিকে দৈনিক বাংলা প্রকাশিত হলো, তখন তিনি সেই দৈনিকটিরও সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করতে পিছপা হননি। সাংবাদিকতা জগতে এ রকম নানা কৃতিত্বই তাকে এখানকার সংবাদমাধ্যমের একজন মহীরুহে পরিণত করেছিল। কিন্তু এত কিছু তিনি নীরবে-নিভৃতেই করতে চেয়েছেন। নিজেকে কখনো পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসতে চাইতেন না।

তোয়াব ভাই সম্পাদকের টেবিলে বসে সংবাদের মূল্যায়ন করেছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য সহকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া থেকে শুরু করে সহায়তা করেছেন এবং সম্পাদকীয় নীতি তৈরি করেছেন। স্বাধীনতার সুফল অবাধ তথ্যপ্রবাহের সাহায্যে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে গিয়েছেন প্রতিনিয়তই। বস্তুনিষ্ঠতার মাধ্যমে নিবেতিপ্রাণ একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের জনমানসে সর্বদা উপস্থিত থাকবেন।

কিছু কিছু মানুষ আছেন, তারা যত দীর্ঘ বয়সেই মারা যান না কেন মনে হয় তাদের অকালপ্রয়াণ হয়েছে। তোয়াব ভাইয়ের মৃত্যুর সময় আমার সেটাই মনে হয়েছে। দীর্ঘ ৭০ বছর সাংবাদিকতা করে ৮৮ বছরে মৃত্যুবরণ করেছেন তোয়াব ভাই। তারপরও মনে হচ্ছে আর কিছুকাল বেঁচে থাকলে, দেশ ও জাতির আরও উপকার হতো। তার মতো একজন সাংবাদিক এবং সম্পাদক যে কোনো দেশের জন্যই বিরল সম্পদ। এ ধরনের একজন মানুষের মৃত্যু প্রকৃত অর্থেই দেশের জন্য একটা বিরাট ক্ষতি হিসেবেই বিবেচিত হয়।

মৃত্যু যে কোনো প্রাণেরই অনিবার্য পরিণতি। আমাদের সবাইকেই এ পরিণতি বরণ করতে হবে। কিন্তু তোয়াব ভাই সাংবাদিকতায় যে আদর্শবাদ আর সৌজন্যের চর্চা করে গিয়েছেন এবং জীবনব্যাপী যে সদাচার আর সংযমের দৃষ্টান্ত তৈরি করে গিয়েছেন, তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের বহু কীর্তিমান আছেন, যারা তোয়াব খানের কাছ থেকে এই পেশার দীক্ষা নিয়েছেন। প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি সেই প্রজন্মের অনেক সাংবাদিক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। তার ফলে আমাদের সাংবাদিকতা শুধু পরিবর্তিতই হয়নি, অনেক উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে।

তোয়াব খানের সঙ্গে কথা বললেই মনে হতো তিনি সময়ের বহু আগেই চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন। প্রবীণ বয়সেও তিনি ছিলেন নবীন এবং সদা উৎসুক। আলস্যহীন উদ্যেম আর পরিশ্রম ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। সে কারণেই বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতার মধ্যেও একটি নতুন দৈনিক সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে তিনি পিছপা হননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার ধমনীতে প্রবাহিত, তিনি কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই মোকাবিলা করতে ভয় পান না। আর সে কারণেই তোয়াব খান সাংবাদিকতার মতো পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় অনন্য ভূমিকা আমৃত্যু পালন করে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়ে গিয়েছেন।

তোয়াব ভাই সত্য প্রকাশে ছিলেন অকুতোভয়। সম্পাদকের টেবিলে বসে সত্য প্রকাশে অবিচল থাকাটাই ছিল তার জীবনের দর্শন। রুশ লেখক আলেকজান্ডার আইসেভিচ সোলঝিনিৎসিন (১৯১৮-২০০৮) বলেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষের কাজ হলো মিথ্যাচারে অংশ না নেয়া আর কবি, লেখক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের কাজ মিথ্যাকে পরাভূত করা।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সাহসী মানুষের কাজ হলো মিথ্যায় না অংশ নেয়া। একটি সত্যি শব্দ গোটা দুনিয়ার চাইতেও বেশি ওজন বহন করে।’ তোয়াব ভাই সম্পাদক, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, মহাপরিচালক, বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি- সব দায়িত্বেই এই দর্শনের প্রতিফলন রেখে গিয়েছেন। সত্য প্রকাশ এবং সততাই যে একজন সাংবাদিকের মূল কর্তব্য, সেটাই তোয়াব ভাই সারা জীবন পালন করে গিয়েছেন। আর তার সাহচর্যে যারাই এসেছেন, তাদের মধ্যে তিনি সুচারুভাবে এই মন্ত্রটিই বপন করে দিতে চেয়েছেন।

আমার মনে আছে উত্তরবঙ্গে যখন বাংলা ভাইয়ের প্রবল প্রতাপ, তখন তিনি তার সম্পাদিত দৈনিকে সবিস্তারে সেই কাহিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিবেদকদের তিনি সে সময় আকুণ্ঠ সমর্থন আর সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন। তিনি সে সময়ে তাদের সত্য প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন এবং প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নেয়ার জন্যও উদ্যেমী করে তুলেছেন। এটাই হলো একজন সত্য প্রকাশে অবিচল একজন বস্তুনিষ্ঠ সম্পাদকের প্রধান কর্তব্য।

সে জন্যই মনে করি, তোয়াব খানের মতো একজন সাহসী সম্পাদকের আরও বেশ কিছুদিন প্রয়োজন ছিল। আসলে তোয়াব খানদের মতো মানুষদের প্রয়োজন সমাজে সবসময়ই থাকবে। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, কিন্তু তার সত্যপ্রকাশের আত্মবিশ্বাস আর আত্মবোধের শিক্ষা আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন। আমরা যদি তার আদর্শ ধারণ করে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে সেটাই হবে তার স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সর্বোৎকৃষ্ঠ পন্থা।

লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়