পুঁজিবাজারে বেশ কিছুদিন পর দরপতন হওয়া কোম্পানির তুলনায় দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানির সংখ্যা বেশি দেখা গেলেও বাজারে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে উত্তরণের বিন্দুমাত্র আভাস নেই। বিপুল সংখ্যক শেয়ার এখনো ফ্লোর প্রাইসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অল্প কিছু কোম্পানিতেই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে লেনদেনের ৪০ শতাংশ কেবল ১০টি কোম্পানিতে। অন্যদিকে লেনদেনের ৩.৬ শতাংশ হয়েছে ২০০ কোম্পানি মিলিয়ে আর ৩০০ কোম্পানি মিলিয়ে হয়েছে লেনদেনের ১৭ শতাংশ। এসব কারণে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে সূচক ও লেনদেন বাড়লেও পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ কাটেনি।
এ দিন আবার যেসব কোম্পানির দর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু লোকসানি, বছরের পর বছর ধরে লভ্যাংশ দিতে পারছে না। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে ওষুধ ও রসায়ন খাতের যে প্রাধান্য দেখা গিয়েছিল, সেটি কিছুটা কমেছে। এ দিন সব খাতকে ছাড়িয়ে গেছে প্রকৌশল। আর ওষুধ খাত নেমেছে তৃতীয় স্থানে। কয়েক সপ্তাহ ধরে ঝিমাতে থাকা বস্ত্র খাত গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েছে। লেনদেন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায় এই খাতের বেশ কিছু কোম্পানিকে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে এ দিন সূচক বেড়েছে ১৮ পয়েন্ট। দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৩১ পয়েন্টে। দর বেড়েছে ১১৫টি কোম্পানির শেয়ারের, বিপরীতে কমেছে ৮১টির। আর আগের দরে লেনদেন হয়েছে ১৭৭টির, যেগুলোর সিংহভাগই ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে। লেনদেন চার কর্মদিবস পর ছাড়াল দেড় হাজার কোটি টাকা। হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৫৩৩ কোটি ৪০ লাখ ৮১ হাজার টাকা, যা আগের কর্মদিবসের চেয়ে ৩১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা। গত বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ২১৬ কোটি ৯৫ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।
পুঁজিবাজারের লেনদেন নিয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘আজ পুঁজিবাজারের লেনদেন কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে বলা যায়। কারণ কিছু দিন থেকে যেসব খাতে বিনিয়োগ বেশি হচ্ছিল বা ওই সব খাত থেকে সরছিল না, সেখান থেকে ফান্ড অন্য খাতেও মুভ করেছে। বস্ত্র খাতেও কিছু ক্রয় প্রবণতা দেখা গেছে।’ সূচকের উত্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দিনের অগ্রভাবে যেসব শেয়ারের দরবৃদ্ধিতে সূচক বাড়ছিল, শেষ দিকে সেগুলোর দর হারানোর কারণে সূচক কমতে থাক। তা ছাড়া সূচক আরও বেশি বাড়তে পারত।’
লেনদেনের ৪০ শতাংশ ১০ কোম্পানিতে: দরপতন হলেও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে ওরিয়ন ফার্মা ও বেক্সিমকো লিমিটেড। ওরিয়নে লেনদেন হয়েছে ১২১ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৮৫ লাখ ৮২ হাজার ৭৬টি। বেক্সিমকোর ৭৬ লাখ ১ হাজার ৩২৩টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১০০ কোটি ৯৩ লাখ ৫২ হাজার টাকায়। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের লেনদেন হয়েছে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। হাতবদল হয়েছে ৬৩ লাখ ২১ হাজার ৩৬টি শেয়ার। এই তিন কোম্পানিরই দরপতন হয়েছে। জেএমআই হসপিটালের ৬৬ কোটি ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪৭ লাখ ৯৫ হাজার ৯৫২টি। বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমসের ১ কোটি ৭৬ লাখ ৪৫ হাজার ২৭৭টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫৭ কোটি ৩৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা। আর কোনো কোম্পানির লেনদেন ৫০ কোটি অতিক্রম করেনি। কপারটেক, শাইনপুকুর সিরামিকস, বিবিএস কেবলস, ইন্ট্রাকো রি-ফুয়েলিং স্টেশন ও বসুন্ধরা পেপারের লেনদেন হয়েছে ৩০ থেকে ৪৫ কোটি টাকার মধ্যে। এই দশটি কোম্পানিতে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১১ কোটি ৮১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। যা মোট লেনদেনের ৩৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে কম লেনদেন হয়েছে এমন ৩০০টি কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ২৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৭.২৪ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে কম লেনদেন হওয়া ২০০টি কোম্পানির ৫৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যা মোট লেনদেনের ৩.৬ শতাংশেরও কম।
ফার্মা-বিবিধ খাত টপকে শীর্ষে প্রকৌশল: দীর্ঘ সময় ধরে লেনদেনে শীর্ষ অবস্থান করছিল ওষুধ ও রসায়ন খাত। এরপর বিবিধ খাতে শীর্ষ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাতে। রোববার লেনদেনে বিকেন্দ্রীকরণ দেখা গেছে। এই দুই খাতকে টপকে শীর্ষে চলে এসেছে প্রকৌশল খাত। হাতবদল হয়েছে ২৩৩ কোটি ১ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৬.০৮ শতাংশ। লেনদেনের সঙ্গে দর বৃদ্ধিও হয়েছে খাতটিতে। ২৩টি বা ৫৪.৭৬ শতাংশ দরবৃদ্ধির বিপরীতে দরপতন হয়েছে ১০টির। আর ৯টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে। বিবিধ খাতে লেনদেন হয়েছে ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ৪টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি ও অপরিবর্তিত ছিল। আর ৬টির দর কমেছে। যে ওষুধ রসায়ন খাতে লেনদেন এক সময় ছয় শ কোটি ছাড়িয়েছিল, তার লেনদেন নেমে এসেছে ২২৯ কোটি ৫০ লাখে। ১২টি কোম্পানির দরবৃদ্ধি, ৮টির দরপতন ও ১০টির কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে আগের দরে। অনেক দিন পর জেগে উঠেছে বস্ত্র খাত। লেনদেন হয়েছে ১৩৭ কোটি ৯২ লাখ টাকার। কিছুটা দরবৃদ্ধি হলেও বিপুল সংখ্যক কোম্পানির লেনদেন হচ্ছে ফ্লোর প্রাইসে। খাতের ২০টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৩৮টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। মাত্র একটি কোম্পানির দরপতন হয়েছে। আর কোনো খাতে এক শ কোটি টাকা লেনদেন হয়নি। সেবা ও আবাসন খাতে লেনদেন হয়েছে ৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার। ২টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি ও দরপতন দেখা গেছে। এ ছাড়াও লেনদেনে এগিয়ে ছিল জ্বালানি, প্রযুক্তি, কাগজ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিরামিকস খাত। এসব খাতের ৫০ কোটি থেকে ৯০ কোটির মধ্যে লেনদেন হয়েছে। শীর্ষ পাঁচ খাতের বাইরে উল্লেখযোগ্য দরবৃদ্ধি হয়েছে- জ্বালানি খাতে ৩৪.৭৮ শতাংশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ৩৬.৩৬ শতাংশ, সিরামিকস খাতে ৬০ শতাংশ, খাদ্য খাতে ৩১.৫৮ শতাংশ, সিমেন্ট ৫৭.১৪ শতাংশ, সাধারণ বিমা ২১.৯৫ ও ব্যাংক খাতে ১৮.১৮ শতাংশ।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০: শীর্ষ দশের সবকটির দরই বেড়েছে সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ ও এর আশপাশে। ১০ শতাংশ করে দর বেড়েছে দুটি কোম্পানির। এর মধ্যে মেট্রো স্পিনিংয়ের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫১ টাকা ৭০ পয়সায়। আগের দিনে দর ছিল ৪৭ টাকা। চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকের হিসাবে শেয়ারপ্রতি এক টাকার কিছু বেশি মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। একই সমান দর বেড়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঋণ কেলেঙ্কারি ও লোকসানে ডুবে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি। শেয়ারটির দর বেড়ে ৬ টাকা থেকে ৬ টাকা ৬০ পয়সায় সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে। বিডিকমের দর ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৭ টাকা ৪০ পয়সায়। বিবিএস কেবলসের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬০ টাকা ৯০ পয়সায়। দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। শীর্ষ পাঁচে অবস্থানকারী ম্যাকসন স্পিনিংয়ের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। হাতবদল হয়েছে ২৬ টাকা ৯০ পয়সায়। বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেম, লোকসানি কেয়া কসমেটিকস ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, আমান ফিড ও কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজও ছিল দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায়।
দরপতনের শীর্ষ ১০: পতনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সি পার্ল। ৭ দশমিক ১২ শতাংশ কমে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ১২১ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়। আগের দিনে লেনদেন হয় ১৩০ টাকা ৬০ পয়সায়। পরের স্থানে ছিল ইনডেক্স অ্যাগ্রো। ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ দর কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৩৪ টাকা ৫০ পয়সায়। তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন। ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ৪১ টাকা ৪০ পয়সায় হাতবদল হয়। দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- শাহজিবাজার পাওয়ার, বিডি ওয়েলডিং, ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স, ফু-ওয়াং সিরামিকস, ইস্টার্ন হাউজিং, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও পেনিনসুলা চিটাগং।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা