জাহাঙ্গীর আলম
গত বছর বাংলাদেশ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় অনেক গৌরবময় অর্জনের সাফল্যগাথা রচনা করেছে বাংলাদেশ। একসময় এ দেশের পরিচয় ছিল অতি দরিদ্র একটি দেশ হিসেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে ঠাঁই করে নেয় বাংলাদেশ। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। গত বছর তা অনুমোদন করেছে জাতিসংঘ। সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্লেনারি সেশনে গৃহীত হয় আমাদের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এই প্রস্তাব। আগামী ২০২৬ সালে স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। এর আগে ২০১৮ সালে জাতিসংঘের মানদণ্ডে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। আগামী ২০ বছর পর দেশে আর কোনো দরিদ্র থাকবে না। এখন থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল গড়ে মাত্র প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার। এখন তা উন্নীত হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫৯১ ডলারে। দেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০৩১ সালে বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং আগামী ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে স্থান করে নেবে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো উল্লেখযোগ্য মজুত ছিল না। এখন তা ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে। বছরের পর বছর আমাদের রপ্তানি আয় দ্রুত বাড়ছে। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে রেমিট্যান্স আয়। একসময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ছিল ছনের ছাউনি দেয়া ঘর। এখন তা আর চোখে পড়ে না। শিক্ষার প্রসার, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাশের দেশ ভারতকেও টপকে গেছে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায়ন বিবেচনায় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের ওপরে আমাদের অবস্থান। গত ১৩ বছর ধরে এ দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ হারে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। ২০৩৩ সালে তা ৮৫৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৪তম। এরই মধ্যে ক্ষুধা সূচকে অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। কমেছে পুষ্টিহীনতা। লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন। শিল্পোদ্যোগ এবং অবকাঠামো বিনির্মাণেও বাংলাদেশ আর পিছিয়ে নেই। এ বছরই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে পদ্মা সেতু। এ ছাড়া মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ১০-১২টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে চলছে দেশি-বিদেশি অর্থায়নে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি খাত। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। এ অঞ্চলে প্রতিবছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টনে। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে সে ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ টনে। গত ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল, সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল দৈনিক ৩ কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক-কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতিবছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষি জমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল দৈনিক ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রুত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষি খাতে। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে। দানাদার খাদ্যশস্যের পর আলুর উৎপাদনে বিপুল উদ্বৃত্ত অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। দেশের মানুষের দৈনিক জনপ্রতি আলুর চাহিদা হচ্ছে ৭০ গ্রাম, প্রাপ্যতা অনেক বেশি। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে আমাদের আলুর মোট উৎপাদন ছিল প্রায় অর্ধকোটি টন। এখন তা ১ কোটি ৯ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। তাতে প্রতিবছর গড়ে আমাদের আয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তা ছাড়া আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবহারও বহুমুখী হচ্ছে। আগে আলুর ব্যবহার হতো মূলত সবজি হিসেবে। এখন তা চিপস ও পটেটো ক্রেকার্স হিসেবেও অনেক সমাদৃত। বিদেশিদের মতো অনেক বাংলাদেশিও এখন মূল খাদ্য হিসেবে রোস্টেড পটেটো খেতে পছন্দ করেন। আলু উৎপাদনে গত ২০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।
খাদ্যশস্যের আরেকটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সবজি উৎপাদনে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সবজি উৎপাদন প্রতিবছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশের কৃষকরা এখন সবজি চাষে বেশ উৎসাহিত হচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন আধুনিক সবজি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বীয় উদ্যোগে এরা গড়ে তুলছেন সবজির খামার।
বাংলাদেশে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ফলের উৎপাদনে। বর্তমানে এ দেশে ফলের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন। ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। গত দুই দশক ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ১১ শতাংশের ওপরে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। ২০০৬ সালে আমাদের মাথাপিছু দৈনিক ফল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৫৫ গ্রাম, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ গ্রামে। তাতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। বর্তমানে আমাদের দেশে আমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিরায়তভাবে গড়ে ওঠা রাজশাহী, চাপাই নবাবগঞ্জ, দিনাজপুরের বাগানগুলো ছাপিয়ে এখন প্রচুর আম উৎপাদিত হচ্ছে সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায়। তা ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ধানি জমি পরিণত হয়েছে আমবাগানে। অধিকন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে নতুন ফল স্ট্রবেরি। আরো চাষ করা হচ্ছে রাম্বুতান, ড্রাগন ফল ও অ্যাভোকাডো। মানুষ আপেলের পরিবর্তে বেশি করে খাচ্ছে কাজি পেয়ারা। তাতে বিদেশি ফলের আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সাশ্রয় হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা।
এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। দীর্ঘ মেয়াদের আবাদি এলাকা কমেছে। তবে একরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০ সালে পাটের জিন রহস্য উন্মোচনের ফলে এর উৎপাদন বৃদ্ধির পথ আরো সুগম হয়েছে। বিশ্ববাজারে এখন পাটের চাহিদা বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। বর্তমান করোনাকালেও পাটের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজার বেশ চড়া। এখন দেশে কৃষকের খামারপ্রান্তে কাঁচা পাটের মূল্য ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা প্রতি মণ। এটা বেশ লাভজনক মূল্য। বর্তমানে দেশে পাটের উৎপাদন প্রতি বছর ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল। আগামীতে এর উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে আবার ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের পাট খাত।
কেবল শস্য খাতই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কৃষির সব উপখাতেই বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। ২০২০-২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ টনে। মৎস্য খাতে বর্তমানে গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। হিমায়িত খাদ্য ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে প্রতিবছর আমাদের আয় ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদনে সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকারের ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধকরণের নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এখন ইলিশের উৎপাদন বহুল পরিমাণে বেড়েছে। তা ছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ এখন ডিম ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ম্ভর। দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে তাতে এর ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই। বন খাতে বৃক্ষের মোট আচ্ছাদিত এলাকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১২ বছর আগে দেশের ৭/৮ শতাংশ এলাকা বনরাজির আওতায় ছিল বলে ধরে নেয়া হতো। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ শতাংশে। উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী এবং গ্রামীণ কৃষি বনায়ন দেশের পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
কৃষি কাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। ভূমি কর্ষণ, ফসল কর্তন ও মাড়াই, ধান ভানা ইত্যাদি ক্ষেত্রেই এখন কায়িক শ্রমের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার। স্বাধীনতার পর ভূমি কর্ষণের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন করা হতো কাঠের লাঙল দিয়ে। ব্যবহার করা হতো পশুশক্তি। এখন পশুশক্তির ব্যবহার হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। বাকি ৯৫ শতাংশই আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখন বেশ প্রচলিত। তবে তার পরিধি এখনো বেশ সীমিত। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। হাওর, চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি। তবে এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম। এটি বাছাইকৃতভাবে এখনো কার্যকর হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চলছে শ্রমিক সংকট। তাতে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। তদুপরি ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে সময়ক্ষেপণ, অপচয় ও অদক্ষতার কারণে কৃষির উৎপাদনে লাভজনকতা হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্প্রতি ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয়েছে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’। ভবিষ্যতে আরো বড় আকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত হবে। যে কোনো কৃষক তার প্রয়োজন অনুসারে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র ক্রয় করতে সক্ষম হবেন।
একসময় নতুন কৃষি প্রযুক্তি প্রসারের একমাত্র বাহন ছিল কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী। এখন তাতে যোগ হয়েছে ই-কৃষি। কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে বাড়ি থেকে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন গ্রামের কৃষক। তাদের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে স্থাপিত হয়েছে কল সেন্টার। যেখান থেকে টেলিফোনে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। এ ছাড়া কৃষিপণ্য বিপণনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে ই-কমার্স। এর মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে কোরবানির পশু। শাকসবজি এবং ফলমূলও এসেছে ই-কমার্সের আওতায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এগিয়ে চলার পাশাপাশি কৃষিকাজের ও পণ্য বিক্রির প্রক্রিয়াও চলে এসেছে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায়। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের মোট কৃষকদের অংশগ্রহণ খুবই কম। অনেকের স্মার্টফোন নেই। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও নেই। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে ১ হাজার গ্রামকে স্মার্ট-ফার্মিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ছোট কৃষকদের অংশগ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এর জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। আর্থিক সহায়তা দিয়ে স্মার্টফোন সংগ্রহে তাদের উৎসাহিত করা দরকার। বাংলাদেশের ছোট কৃষকরা অধিক উৎপাদনশীল। তারা কৃষিকাজে নিজেরাই শ্রম দেন। উৎপাদন পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি করেন তারাই। ফলে তাদের খামারে প্রতি ইউনিট উৎপাদন বেশি। খরচ কম। উৎপাদন দক্ষতাও বেশি। কিন্তু সমস্যা পুঁজিস্বল্পতা। নতুন প্রযুক্তি ধারণ ও বিস্তারে ছোট কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কৃষি উপকরণে তাদের অভিগম্যতা। এটা নিশ্চিত করার জন্য ছোট কৃষকদের অনুকূলে নগদ সহায়তা প্রদান ও বরাদ্দ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিবাচক নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা