২০১১ সালে দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান (সিজারিয়ান) প্রসবের হার ছিল ১৮ শতাংশ। মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে এ হার বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছেছে ৪৫ শতাংশে। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক শিশুর জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান প্রসবে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসবের হার অনেক বেশি। সেখানে ৬৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় সিজারিয়ানের মাধ্যমে। অর্থাৎ খুলনা বিভাগে প্রতি তিনজন অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মধ্যে দুজনের সন্তান জন্ম নিচ্ছে সিজারিয়ানের মাধ্যমে। তবে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম। সেখানে মাত্র ২৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় সিজারিয়ানের মাধ্যমে। অর্থাৎ সিলেট বিভাগে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ানের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) আর্থিক সহায়তায় জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট), আইসিডিডিআর,বি এবং আইসিএফ যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ২০২২ সালের ২৭ জুন থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ৩০ হাজার ১৮ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। চলতি মাসে খুলনায় স্বাস্থ্যবিষয়ক এক সেমিনারে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দেশে মোট শিশু জন্ম নিয়েছে ৩৬ লাখ ২ হাজার ৫০৬ জন। এর মধ্যে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে ১৬ লাখ শিশু। যার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮ শিশুর, বেসরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪২ ও এনজিওর হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে ২২ হাজার ১৩৬ শিশুর। অর্থাৎ সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুর ৮৪ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ শিশুর।
এদিকে দেশে প্রতিবছরই সিজারিয়ানের হার বাড়ছে। প্রতিবেদনে বিগত কয়েক বছর পূর্বের তথ্যের সঙ্গে বর্তমান তথ্যের পার্থক্য নির্ণয় করা হয়েছে। দেখা গেছে, ২০১১ সালের সিজারিয়ানের হার ছিল ১৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৪ শতাংশ ও ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশে।
প্রতিবেদনের মতে, গর্ভকালীন অবস্থায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাপ্রদানকারীর কাছ থেকে সেবা পেয়েছেন ৮৮ শতাংশ নারী। তবে মাত্র ২১ শতাংশ নারী জানিয়েছেন তারা মানসম্মত সেবা পেয়েছেন, বাকিরা সেবায় সন্তুষ্ট নন। দেশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে দরিদ্রদের প্রসবসেবা নেয়ার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে ছয়জন ধনী নারীর বিপরীতে মাত্র একজন দরিদ্র নারী হাসপাতালে গিয়ে প্রসবসেবা নিতেন। তবে বর্তমানে প্রতি দুই ধনী নারীর বিপরীতে একজন দরিদ্র নারী হাসপাতালে গিয়ে প্রসবসেবা নিচ্ছেন।
গর্ভকালীন নারীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার একপর্যায়ে প্রতাণার শিকার হয়ে সিজারিয়ানে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন এই গবেষণা দলে থাকা বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআর,বির মা ও শিশু স্বাস্থ্য গবেষক আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় সিজার করা বড় একটি অপরাধ। এর মাধ্যমে মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে অনেক মা পরবর্তী সময়ে আর ভারী কাজ করতে পারেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমবার কোনো মায়ের সিজারিয়ান করানো হলে দ্বিতীয়বারও সন্তান প্রসবের সময়ে তাকে অস্ত্রোপচারই করাতে হয়। স্বাভাবিক প্রসবের থেকে সিজারিয়ানে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলো নিজেদের আর্থিক সুবিধার জন্য এসব অপ্রয়োজনীয় সিজার করছে।’
অপুষ্টি নিয়ে বড় হচ্ছে চারজনে একজন
প্রতিবেদনের শিশুর পুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাসে বলা হয়েছে, ডব্লিউএইচও গ্রোথ স্ট্যান্ডার্ড-২০০৬-এর ভিত্তিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২৪ শতাংশের বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম হচ্ছে। এর জন্য দায়ী হচ্ছে অপুষ্টির শিকার হওয়া। এ ছাড়া বয়সের তুলনায় ওজন কম নিয়ে বড় হচ্ছে ২২ শতাংশ ও উচ্চতার তুলনায় ওজন কম নিয়ে বড় হচ্ছে ১১ শতাংশ শিশু। ছয় মাস থেকে ২৩ মাস বয়সী প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে মাত্র তিনজন শিশুকে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের অনুশীলন করানো হচ্ছে। এ ছাড়া মায়েদের মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রবণতাও কমে গেছে। ২০১৭ সালে ৬৫ শতাংশ নারী ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতেন। তবে ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশে।
হাজারে ৩১ জন শিশু মারা যাচ্ছে
বর্তমানে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি এক হাজারে ৩১ জন মারা যাচ্ছে। তবে এই মৃত্যুর হার দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১ সালে প্রতি হাজারে মারা যেত ৪৮ শিশু, ২০১৪ সালে ৪৭, ২০১৭ সালে হাজারে ৪৩ শিশুর মৃত্যু হতো। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর সাত কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ২৪ শতাংশ, অপরিণত অবস্থায় জন্মের কারণে ২২ শতাংশ, জন্মগত শ্বাসকষ্টে ১৮ শতাংশ, জন্মগত অস্বাভাবিকতায় ৭ শতাংশ, পানিতে ডুবে ৬ শতাংশ, গুরুতর সংক্রমণে ৪ শতাংশ ও ডায়রিয়ায় ৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়।
তবে বয়সভেদে শিশুমৃত্যুর ভিন্নতা রয়েছে। নবজাতকরা প্রতি এক হাজারে মারা যাচ্ছে ২০ জন। যার মধ্যে অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্মের কারণে মৃত্যু হচ্ছে ৩২ শতাংশের, জন্মগত শ্বাসকষ্টে ২৭ শতাংশ, নিউমোনিয়া সংক্রমণে ২৬ শতাংশ ও অন্যান্য রোগে ১৫ শতাংশ শিশু মারা যাচ্ছে।
তবে ১ থেকে ১১ মাস বয়সী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে মারা যাচ্ছে পাঁচজন। এর মধ্যে নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে ৪১ শতাংশ, ডায়রিয়ায় ১১ শতাংশ, গুরুতর সংক্রমণে ৫ শতাংশ ও অন্যান্য রোগে ৪৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আর ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে মারা যাচ্ছে ছয়জন। যার মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ, নিউমোনিয়ায় ১২ শতাংশ, জন্মগত অস্বাভাবিকতায় ৬ শতাংশ ও অন্যান্য রোগে মারা যাচ্ছে ৩৭ শতাংশ শিশু।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো. মনজুরুল মুরশিদ বলেন, ‘মায়ের গর্ভকালীন থেকে শুরু করে সন্তানের বেড়ে ওঠা নিয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। তাহলে শিশুদের মৃত্যুর হার আরও কমিয়ে আনা যাবে। আমাদের টার্গেট রয়েছে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে ২৫ জনের কম মৃত্যুর লক্ষ্যমাত্র অর্জন করার। সেই লক্ষ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা