নাসির আহমেদ
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন তিনি, দৈনিক বাংলা ও নিউজ বাংলার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় তোয়াব খান, মাত্র দুদিনের ব্যবধানে তার কথা বলতে গিয়ে ‘ছিলেন’ শব্দটা লিখতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠল! কারণ, তোয়াব খান, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় তোয়াব ভাই চিরবিদায় নিয়েছেন। গতকাল বনানী কবরস্থানে তার সমাহিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতার এক পথিকৃতের বিদায়ই শুধু ঘটেনি, অবসান ঘটেছে একটি আলোকিত সোনালি অধ্যায়েরও। ১ অক্টোবর দুপুরে তার প্রয়াণ সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে সোমবার সকালে তেজগাঁয় দৈনিক বাংলা কার্যালয়, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং গুলশান আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত অন্তিম জানাজাসহ কবরস্থান পর্যন্ত সর্বত্রই তাকে ঘিরে ছিল বাংলাদেশের সব গণমাধ্যম এবং তরুণ প্রজন্ম। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক নেতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বরেণ্যজনেরাসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় তাকে শেষবিদায় জানিয়েছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর! বিস্ময়ের কারণ একটাই- তা হলো ব্যক্তিজীবনে তোয়াব ভাই ছিলেন অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং কর্মনিমগ্ন একজন নিভৃতচারী মানুষ। সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, টিভি টক শো, বক্তৃতা-বিবৃতি
এর কোনো কিছুতেই ছিলেন না তোয়াব খান।
কিন্তু প্রচারের আলোয় কোথাও না থেকেও, সবার পেছনে আড়ালে থেকেও সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন তিনি, সবার চেয়ে সামনে ছিলেন তিনি।
এর একটাই কারণ, তা হলো তোয়াব খান ছিলেন পেশাদারিত্বে
এমনই নিষ্ঠাবান এক সম্পাদক যিনি নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছিলেন। বয়সে প্রবীণ হয়েও মেধা-প্রতিভায় তিনি ছিলেন তরুণদের চেয়েও তরুণ। এমনকি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও তিনি ছিলেন সচেতন এবং তার পঠন-পাঠন ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের।
কাজ ছাড়া এক মুহূর্ত তিনি থাকতে পারতেন না। গত রোববার দৈনিক বাংলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শরিফুজ্জামান পিন্টুর স্মৃতিচারণামূলক লেখা যারা পড়েছেন তারা জেনেছেন নতুন কর্মস্থল এই দৈনিক বাংলাকে তার মেধা ও প্রতিভা দিয়ে গড়ে তোলার জন্য কী আকুতি ছিল তার! কবে লিফট বসানো শেষ হবে, সেজন্য তিনি ছিলেন উদগ্রীব। এই কর্ম পিপাসাই তার তারুণ্যের উৎস। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন তরুণ সাংবাদিকদেরও প্রতিযোগী। অশীতিপর বয়সেও তথ্যে তিনি সমৃদ্ধ ছিলেন, নিজেকে তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি কখনো।
১৯৭২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সবসময় তিনি থেকেছেন গণমাধ্যম জগতের নেতৃত্বে, কিন্তু সেই নেতৃত্বকে নিজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে কখনো ব্যবহার করেননি। ক্ষমতার সঙ্গে থেকেও ক্ষমতার মোহ-মাৎশ্বর্য থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন নিজেকে। এটি অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। যে কারণে তোয়াব খান বঙ্গবন্ধুসহ দেশের তিনজন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হয়েও কখনো বিতর্কিত হননি, কলঙ্কিত হননি। পেশাদারিত্বের দিক থেকে যতটুকু কাজ করা প্রয়োজন সেটুকুই করেছেন। কাজের দক্ষতায় তিনি ছিলেন অনিবার্য।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরার পর ১৯৭২ সালের শুরুতেই বার্তা সম্পাদক তোয়াব খানের ওপরই দৈনিক বাংলার সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব বর্তায়। মেধা-প্রতিভা আর অপরিসীম নিষ্ঠায় তিনি দৈনিক বাংলাকে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিকতম পত্রিকা হিসেবে পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন। একটি প্রগতিশীল আধুনিক দৈনিক হিসেবে দৈনিক বাংলা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এ কালের পাঠক কিংবা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না ৫৮ বছর আগে এই দৈনিক বাংলারই বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ‘সংবাদ’ থেকে আসা এক তরুণ সাংবাদিক, তার নাম তোয়াব খান। সংবাদও এ দেশের সাংবাদিকতার এক ঐতিহাসিক প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে তাকে দৈনিক বাংলা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রেস সচিব করে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দৈনিক বাংলায় ফিরতে পারেননি তিনি। তাকে পিআইডি, পিআইবিসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উইংয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুনরায় সম্পাদক হিসেবে তিনি ফিরে এসেছিলেন ১৯৯১ সালে। কিন্তু তখন দৈনিক বাংলা এক ডুবন্ত জাহাজ। সেই ডুবন্ত জাহাজটি তিনি তার নিষ্ঠা আর মেধা-প্রতিভা দিয়ে টেনে তুলেছিলেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল দৈনিকটি, আর সেই সময়েই (১৯৯২)তাকে চাকরিচ্যুত করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার।
দৈনিক বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস। ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর আজকের এই দৈনিক বাংলা প্রকাশ করেছিল প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। এর তৎকালীন নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরদিন এই পত্রিকার নামকরণ হয় প্রথমে ‘দৈনিক বাংলাদেশ’, পরে ‘দৈনিক বাংলা’। সরকারি পত্রিকা হয়েও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই পত্রিকাটি পাকিস্তান আমলে। চমৎকার মেকআপ, গেটআপ, নিউজের উন্নত মানের টেক্সট, আকর্ষণীয় ফিচার এবং দৃষ্টিকাড়া লাইনো টাইপের ঝকঝকে মুদ্রণ মন কেড়েছিল সবার।
দেশের প্রগতিশীল সাহিত্যিক-সাংবাদিক লেখকরা যুক্ত হয়েছিলেন এই পত্রিকার সঙ্গে। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো কবিদের পাশাপাশি এই কাগজে যোগ দিয়েছিলেন সেকালের অনেক স্বনামখ্যাত সাংবাদিক। পত্রিকাটির নতুন অনেক কিছুরই পরিকল্পক ও নেপথ্য কারিগর ছিলেন তোয়াব খান।
নিউজ আর ফিচার পাতাগুলোর মেকআপ ছিল আন্তর্জাতিক মানের। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সরকারি ট্রাস্টের কাগজ হয়েও দৈনিক পাকিস্তান ছিল বাংলার মানুষের অধিকারের পক্ষে! সেই প্রগতিশীল সাহসী সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতা তথা গৌরবের ঐতিহ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল।
গত বছর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে দৈনিক বাংলায় তোয়াব ভাই সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন, তখন একটি লেখা ডামি সংখ্যায় লিখেছিলাম। তাতে তার অসামান্য সাফল্যের কিছু স্মৃতিচারণাও করেছিলাম। দীর্ঘ ২৪ বছর পর বেসরকারি মালিকানায় দৈনিক বাংলা প্রকাশিত হলো এবং এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তোয়াব খান, এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে এক আনন্দের সংবাদ ছিল। কিন্তু দৈনিক বাংলার যাত্রালগ্নেই চিরতরে চলে গেলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় তোয়াব খান । এটা শুধু দৈনিক বাংলার জন্য দুঃখের ঘটনা নয়, গোটা দেশের গণমাধ্যমের জন্যও এক চরম দুঃসংবাদ।
আমার সাংবাদিকতা জীবনে সাতজন সম্পাদকের নেতৃত্বে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সবকিছুতেই তোয়াব খান অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ তার প্রাণের স্পন্দন হলেও সম্পাদক হিসেবে তিনি বিস্ময়করভাবে নিরপেক্ষ। শতভাগ পেশাদার। সততা, দক্ষতা আর যোগ্যতাই তার কাছে পছন্দের মাপকাঠি। যে কারণে সম্পূর্ণ ভিন্নমতের বহু সাংবাদিককে তিনি তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠে। যোগ্যতার মানদণ্ডেই তিনি সবার কাজের মূল্যায়ন করেছেন।
একটানা দীর্ঘ ১৫ বছর তার সান্নিধ্যে থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সর্বক্ষণ তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল কাগজের মানোন্নয়ন এবং সৃজনশীলতায় নতুন উদ্ভাবন। দেশের সব দৈনিকে আজ শিক্ষাপাতা দেখা যায়। এরও পথিকৃৎ তোয়াব খান। ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামের দেশ কাঁপানো প্রতিবেদন জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় চালু করে দেশের ৬৪ জেলার স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন তিনি।
একটি দৈনিক পত্রিকা যে সংবাদ আর অভিমত প্রকাশের বাইরেও বহু সামাজিক কল্যাণমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেই পথও এ দেশে তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন জনকণ্ঠের মাধ্যমে গুণীজন সম্মাননা, মাসিক সম্মানী ভাতা ইত্যাদি প্রদান করে। যতদিন মালিক কর্তৃপক্ষ পত্রিকার টেক্সট নিয়ে হস্তক্ষেপ করেননি, সাংবাদিকতা বুঝতে যাননি, ততদিনই দৈনিক জনকণ্ঠ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটিয়ে অসাধ্য সাধন করে একটি উৎকৃষ্ট দৈনিক হিসেবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানুষের ঘরে ঘরে টিকে ছিল।
তোয়াব ভাই কতটা নির্মোহ মানুষ ছিলেন তার একটি দৃষ্টান্ত দিই। ২০০৮ সালের শেষের দিকে ঢাকার একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা তাকে সম্পাদক হিসেবে পাওয়ার জন্য খুবই চেষ্টা করেছিল। তখন দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক প্রকাশক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ কারাগারে। জনকণ্ঠে তিনি যে বেতন পেতেন তার তিন গুণ বেতনে তাকে নিয়োগ করার প্রস্তাব নিয়ে ওই পত্রিকাটির মালিক কর্তৃপক্ষ তার বাসায় গিয়েছিল। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর্থিক প্রলোভনে তিনি তার পুরোনো কর্মস্থল ত্যাগ করেননি।
পঠন-পাঠনে তিনি এতটাই দীর্ঘ ছিলেন যে অর্থনীতি থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি থেকে ফ্যাশন-ডিজাইনিং সব বিষয়ে ছিল তার অগাধ জ্ঞান। পেশাগত জীবনে শতাধিক রাষ্ট্র ভ্রমণ করেছেন। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রপ্রধানদের স্মৃতি তার নখদর্পণে ছিল। জনকণ্ঠে যখন এডিটোরিয়াল মিটিংয়ে আমরা বসতাম তার সঙ্গে তখন বিশ্বের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নানা বিষয়ে তার বিশ্লেষণ মূল্যায়নে মুগ্ধ হতাম।
এ রকম একজন সজ্জন সম্পাদক এ দেশে আর হবে কি না জানি না। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি তরুণতম গিরীশ গৈরিক পর্যন্ত সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন আশ্চর্য দক্ষতায়। কারণ মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন তরুণ। সেই তারুণ্যের আলোকেই তিনি উদ্ভাসিত থেকে যাবেন আমাদের স্মৃতিতে আরও বহুকাল এক কিংবদন্তির গল্প হয়ে। যেখানেই থাকুন তোয়াব ভাইয়ের আত্মা চিরশান্তি লাভ করুন।
নাসির আহমেদ: কবি ও কলামিস্ট, সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন। দৈনিক বাংলা ও দৈনিক জনকণ্ঠে তোয়াব খানের সঙ্গে ১৬ বছর কাজ করেছেন।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা