দেশের অর্থনীতিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে চিংড়িশিল্প। খুলনা অঞ্চলের প্রান্তিক চাষিদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও সহায়তা করছে ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়ি। বর্তমানে উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত এ শিল্পের সঙ্গে। তবে কতিপয় দুষ্টচক্রের ‘কালো হাতের’ থাবায় এ শিল্পটি এখন হুমকির মুখে।
অবৈধভাবে বেশি মুনাফা অর্জনের আশায় তারা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করছে। একের পর এক অভিযানে জেল-জরিমানা করেও কোনোভাবেই তাদের থামানো যাচ্ছে না।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনা অঞ্চল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পাঠানো সাত কনটেইনার চিংড়িতে জীবাণু পেয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানির প্রায় ২০ হাজার বক্স চিংড়ি ফেরত এসেছে। এগুলো মোংলা বন্দরে খালাসের পর কোম্পানিগুলো ফেরত নিয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছর সময়ে এসব চিংড়িতে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া, সিরিঞ্জের ভাঙা নিডল, মেলাকাইট গ্রিন অ্যান্টিবায়োটিক, ভিভরিওপ্যারা ভাইরাস ও সিমি কার্বাজাইড অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্ত হয়েছে।
খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানির জন্য মোট ৫৪টি কারখানা রয়েছে। বর্তমানে চালু রয়েছে ৩০টি কারখানা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেখান থেকে বিশ্বের ৫২টি দেশে ১৯ হাজার ৯০৪ দশমিক ৮৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করা হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ২ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে মোট রপ্তানি করা মাছের ৮০ শতাংশ আয় হচ্ছে চিংড়ি থেকে।
চিংড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলো সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে চিংড়ি কেনে না। তারা অ্যাকাউন্টহোল্ডারের মাধ্যমে চিংড়ি কিনে থাকে। অ্যাকাউন্টহোল্ডাররা কমিশনের ভিত্তিতে চিংড়ি নেয় স্থানীয় ডিপো থেকে। বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিদের কাছ থেকে আসা চিংড়ি কারখানাগুলোতে সরবরাহ করে ওই ডিপোগুলো। খুলনার নতুন বাজার ও রূপসায় এমন সাত শতাধিক ডিপো রয়েছে। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার ঘটনা ঘটে মূলত এসব ডিপোতেই। কয়েকটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে তারা অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি বিক্রি করে।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু আহাদ হাফিজ বলেন, ‘প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে বিদেশি বায়াররা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে চিংড়ি রপ্তানি করতে বলেন। ওই সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে চিংড়ি তারা সংগ্রহ করতে না পারলে অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়িও কিনে থাকেন। কারখানাগুলোর সহায়তা ছাড়া অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি বিক্রি করা সম্ভব নয়। আমরা বারবার তাদের অনুরোধ করেছি পুশ করা চিংড়ি না কিনতে।’
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশবিরোধী মোট ১৭০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে ৩৯ হাজার ৫২২ কেজি পুশ করা চিংড়ি বিনষ্ট করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৪৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা ও সাতজনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আবু আহাদ হাফিজ বলেন, ‘যে অভিযানগুলো করা হচ্ছে, তা শুধু চিংড়ির ডিপোতে। তবে যারা প্রধান দায়ী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করা হচ্ছে না। প্রশাসনের উচিত কারখানাগুলোতে বেশি অভিযান পরিচালনা করা। সেখানে যদি পুশ করা চিংড়ি কেনা না হয়, তাহলে কোনো ডিপোতেই চিংড়ি পুশ করবে না।’
তবে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে ভিন্ন কথা। সংগঠনটির পরিচালক এস হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের চিংড়ি রপ্তানির পর বায়াররা যদি ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেশি পান, তাহলে সেই মাছ ফেরত আসে। এতে সেই চালানে কম হলেও ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা লোকসান হয়। তাহলে আমরা এটা করেতে যাব কেন? লোকসানটা তো আমাদের হবে। কোনো কোনো কোম্পানির কিছু কর্মী এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তা দেখার জন্য আমরা কমিটি করে দিয়েছি। আমরা চাই এই চক্রের যেকোনো সদস্য ধরা পড়লে জরিমানার পাশাপাশি তাদের জেল দেয়া হোক। তাহলে তাদের উৎপাত কমে যাবে।’
মৎস্য পরিদর্শক ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘মাছ ফেরত আসা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। নানা কারণে ফেরত আসতে পারে। রপ্তানির সময় চিংড়ি সব সময় নিম্ন তাপমাত্রায় রাখতে হয়। কোনো কারণে তাপমাত্রা ফেল করলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। শুধু আমাদের দেশের নয়, ইউরোপ থেকে বিভিন্ন দেশের মাছ ফেরত যায়। ওই দেশের মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ স্থানীয় মার্কেট থেকে স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করে এসব জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে।’
ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির সুনাম রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের চিংড়ির মান ভালো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের কয়েকটি মানদণ্ড দিয়েছে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর চিংড়ি বিদেশে পাঠানোর ছাড়পত্র দেয়া হয়।’
চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ, অন্টিবায়োটিক ও জীবাণুর উপস্থিতি থাকায় ২০০৯ সালে ইউরোপ বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের চিংড়ি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি পরিদর্শন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিশারিজ অ্যান্ড ভেটেরিনারিজ অর্গানাইজেশন (ইভিএফভিও)।
মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের খামার, ডিপো ও হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবে। চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণে আমরা তাদের মানদণ্ড পূরণ করে আসছি।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা