আপডেট : ৫ অক্টোবর, ২০২২ ০৭:৫৯
একই আঙিনায় মন্দির ও মসজিদ

একই আঙিনায় মন্দির ও মসজিদ

লালমনিরহাটে পুরান বাজার জামে মসজিদ এবং কালীবাড়ি দুর্গামন্দির ও কালীমন্দিরের সহাবস্থান।

মো. শাহ্জাহান সাজু, লালমনিরহাট

লালমনিরহাট জেলা শহরের পুরান বাজার এলাকা। এখানে একই সীমানাপ্রাচীরের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে পুরান বাজার জামে মসজিদ এবং কালীবাড়ি দুর্গামন্দির ও কালীমন্দির। বিগত দুই শতাব্দী ধরে মসজিদে চলছে মুসলমানদের নামাজ, আর সেই মসজিদ লাগোয়া মন্দিরে বাজছে কাঁসর ঘণ্টা, চলছে পূজা অর্চনা।

এক পাশে সৌরভ ছড়াচ্ছে ধূপকাঠি, অন্য পাশে আতরের সুঘ্রাণ মসজিদে। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করে যুগ যুগ ধরে চলছে পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি।

গত শনিবার দুপুরে মহাষষ্ঠী পূজায় দেখা গেছে, জোহরের নামাজের আজানের সময় থেকে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাকঢোলসহ যাবতীয় শব্দ বন্ধ রেখেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। নামাজের জামাত শেষ হলে মন্দিরের পূজা অর্চনার কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবেই দুটি ভিন্ন ধর্মের মানুষ পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে পালন করছেন ধর্মাচার।

১৮৩৬ সালে দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে ঠাঁই নেন শ্রীশ্রী কালীমূর্তি, দেবাদিদেব মহাদেব, শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথ। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় চলে এসব দেবদেবীর পূজা অর্চনা। দুর্গামন্দিরে প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। পরে পুরান বাজার সম্প্রসারিত হলে ১৯০০ সালে বাজারের ব্যবসায়ীরা মন্দির প্রাঙ্গণে একটি নামাজের ঘর নির্মাণ করেন। সেই নামাজের ঘরটিই পরবর্তী সময়ে পুরান বাজার জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে নামাজ আদায় করতে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন।

স্থানীয়রা বলেন, কালীবাড়ি মন্দিরটি প্রায় ২০০ বছরেরও পুরোনো। তৎকালীন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজা অর্চনা করতেন। তারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও মন্দিরটি থেকে যায় অক্ষত। পরবর্তী সময়ে অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে মন্দিরে। দুর্গাপূজা যখন শুরু হয়, সে সময় এলাকাটি হয়ে ওঠে আনন্দমুখর।

‘ধর্মীয় সম্প্রীতি কী, ধর্মীয় সম্প্রীতি কাকে বলে, তা কেমন হওয়া উচিত- তা জানার জন্য, দেখার জন্য সবার এখানে আসা উচিত,’ বললেন মন্দিরের পুরোহিত সঞ্জয় কুমার চক্রবর্তী। তিনি আরো বলেন, ‘মন্দিরে নিয়মিত পূজা অর্চনা হয়। আজান ও নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটে- এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে কোনো দিনই পড়তে হয়নি বরং স্থানীয় মুসল্লিদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি। উভয় ধর্মের অনুসারীরা এটা নিয়ে গর্ব করেন। পৃথিবীজুড়ে চলমান সহিংসতা আর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংবাদের মধ্যে এমন দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।’

পুরান বাজার জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে একই উঠানে দুইটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আমরা মুসলমান এবং হিন্দুরা যে যার ধর্ম সুষ্ঠুভাবে পালন করে আসছি। আমরা নামাজ পড়ছি, তারা পূজা করছেন। কেউ কারো ধর্মে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। আমাদের উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মীয় আচার-বিধি পালন করা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’

একই মসজিদের ইমাম মো. আলাউদ্দিন বলেন, ঐতিহ্যবাহী পুরান বাজার জামে মসজিদের পাশেই এক সঙ্গে দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। মন্দিরটি মসজিদের আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করেন।

একই আঙিনায় দাঁড়িয়ে পুরান বাজার কালীবাড়ি মন্দিরের সভাপতি ও পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার জন্মের পর থেকেই এভাবে চলতে দেখছি উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনকে। কোনো সমস্যা হয়নি কখনো। আশা করি, হবেও না।’

এ বিষয়ে লালমনিরহাট পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে এলে আমি অভিভূত হই সব সময়। এখানে যে যার ধর্ম পালন করছেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এবার দুর্গাপূজা ঘিরে এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বেড়েছে। প্রতিটি পূজামণ্ডপে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন।’

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো আবু জাফর বলেন, ‘এখানকার মানুষ ধর্মীয় সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করেন। আর এই বিশ্বাসের প্রমাণ তারা দিয়ে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় আমরাও প্রশাসনের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছি, যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।’