মালঞ্চ। সাতক্ষীরার সুন্দরবনে থাকা এই নামের নদীটির কথা প্রায় সবারই জানা। রাজশাহীতেও এ নামে পৃথক আরেকটি নদী রয়েছে। কিন্তু ফরিদপুরেও যে এ নামে একটি নদী রয়েছে, তা জানা নেই অনেকেরই।
স্থানীয়দের দাবি, কয়েক শ বছরের ইতিহাস থাকলেও সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে না থাকায় এ নদীর তথ্য আড়ালেই রয়ে গেছে। কাগজে-কলমে নাম না থাকা এ নদী এখন বাস্তবেও পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে।
স্থানীয়রা জানান, ফরিদপুরের সালথা উপজেলার গট্টিবাজারে কুমার নদ থেকে উৎপত্তি মালঞ্চ নদীর। এরপর সিংহপ্রতাপ, গৌড়দিয়া, সলিয়া, সেনহাটি, খাগৈড়, গোয়ালপাড়া, গোবিন্দপুর ও দুর্গাপুর গ্রামের ওপর দিয়ে নদীটি বয়ে গেছে। বিভিন্ন জনপদ ও গ্রাম পেরিয়ে নদীটি ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবারও কুমার নদের সঙ্গে মিশেছে। এ জন্য অনেকে এটিকে কুমার নদের অংশও মনে করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩০-৪০ বছর আগেও নানা জাতের দেশীয় মাছে পূর্ণ ছিল মালঞ্চ নদী। চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত মাছ সারা বছরের সংস্থানের জন্য শুঁটকি করে রেখে দিতেন স্থানীয়রা। কালের বিবর্তনে নদীটি তার রূপ-লাবণ্য হারিয়েছে। উদাসীনতা-অবহেলায় নদীটির অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এ নদীর নাম জানে না।
স্থানীয়রা জানান, সুন্দরবন ও রাজশাহীতে মালঞ্চ নামে পৃথক দুটি নদী রয়েছে। তবে সেগুলোর বয়স খুব বেশি নয়। বরং ফরিদপুরের মালঞ্চ নদীর ইতিহাস কয়েক শ বছরের পুরোনো। শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে মালঞ্চ নদীর বুকে চর জেগে ওঠে। সম্প্রতি খনন করায় এখন শুকনো মৌসুমেও সেখানে হাঁটুপানি থাকে। বর্ষায় পানিতে ভরে ওঠে নদীর বুক। তখন এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল পাট জাগ দেয়া হয় সেখানে। এরপর পাটের পঁচা পানি নিয়েই বয়ে চলে নদী। তবে এমন সুন্দর স্নিগ্ধতা ছড়ানো নদীটি সবার অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে।
মালঞ্চ নদীর নামকরণের নেপথ্যে মিশে রয়েছে এক করুণ শোকগাথা। স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক সুধীর দত্ত ওরফে উত্তম জানান, নবাবী আমলে সালথায় বড় জমিদার ছিলেন প্রতাপ সিংহ। তার মেয়ের নাম ছিল মালঞ্চ। এই নদীতে নৌকায় বাড়ি ফেরার সময় সে নৌকাডুবিতে মারা যায়। তার নাম অনুসারে এই নদীর নামকরণ হয় মালঞ্চ।
সালথার সাংবাদিক শ্রাবণ হাসান বলেন, ‘এমন একটি সুন্দর নামের নয়নাভিরাম নদী রয়েছে আমাদের সালথায়। অথচ তেমনভাবে কখনো চর্চা করা হয়নি এর ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগই এ নদীর নাম জানে না। এটা খুবই হতাশাজনক।’
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ষাট থেকে আশির দশকেও এই নদীতে দেশীয় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করে রাখা হতো। সেই ভরা ঐশ্বর্যের মালঞ্চ নদী আজ কেবল নাব্যই হারায়নি, নামটিও হারাতে চলেছে।’
সচেতন মহল বলছে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে আরও অনেক নদ-নদীর মতো মালঞ্চেরও রূপ-লাবণ্য ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।
ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্ম এই নদীর নাম জানে না, যা খুবই উদ্বেগজনক। এখন নদীটি রক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি এর নামটিও সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ থাকা দরকার।’
সালথা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, ‘এ নদীর বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই জানতে পারলাম। খোঁজখবর নিয়ে দেখব। যদি সরকারি নথিপত্রে এই নদীর নাম ও তথ্য না থাকে, তাহলে তা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেব।’
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, ‘মালঞ্চ নদী সম্পর্কে সেভাবে জানা নেই। আমরা সারা দেশের নদীর তথ্য হালনাগাদ করছি। যদি এটি নদীর শ্রেণিভুক্ত হয়, তাহলে অবশ্যই নদ-নদীর তালিকাভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমরা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা