সরকারের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। (প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন চাই না।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ফখরুল এ কথা বলেন। রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে গত শনিবার বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগ করে তার প্রতিবাদে এই সমাবেশের আযোজন করা হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আর আমান উল্লাহ আমানের সঙ্গে (গত শনিবার) যে নাটক হয়েছে সেই নাটকে ওনারা ছোট হননি। ছোট হয়েছো তোমরা।’
শনিবার বিএনপির কর্মসূচির সময় ধোলাইখালে পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। পরে তাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সেই আপ্যায়নের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অন্যদিকে গাবতলীতে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন আমান উল্লাহ আমান। তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে আমানকে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রীর এক প্রতিনিধি। ওই সময় আমানকে খাবার, ফল ও জুসের প্যাকেট দেয়া হয়। সেই ছবিও প্রকাশ হয় সংবাদমাধ্যমে। বিএনপির অভিযোগ, নেতা-কর্মীদের দ্বিধান্বিত করতে সরকার এমনটি করেছে।
ফখরুল সমাবেশে বলেন, ‘এই সরকারের পায়ের মাটি সরে গেছে। তাই তারা আমাদের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা-তল্লাশি চালাচ্ছে। এটা করে তো আমাদের এই ১৫ বছর আটকানো যায়নি। এগুলো করে মানুষের ঢল থামানো যাবে না।’
তিনি বলেন, “কয়েকটা লোককে বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। তার মধ্যে একটা নাকি আমেরিকার লোক। যার নামও কেউ কোনো দিন শোনেনি। সে আবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বক্তৃতা করে আর প্রেসকে বলে, ‘এখানে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট (তত্ত্বাবধায়ক) সিস্টেম চলবে না’। বারে বাহ! তুমি কে ভাই? হু আর ইউ! এদেরকে কেউ চেনে না। টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। এদের গতবারও নিয়ে আসা হয়েছে। যেই ফোরামের হয়ে তারা এসেছে সেই ফোরাম এবং এটার প্রতিষ্ঠাতা যে আবেদ তাকেও দেশের মানুষ কেউ চেনে না। এই ধরনের ভাঁওতাবাজি করে মানুষকে বোকা বানাতে চায় তারা। এই সরকারের পায়ের মাটি কত দুর্বল হলে এই ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করা যেতে পারে কল্পনা করুন। এই দেশের মানুষ নির্ধারণ করে ফেলেছে নির্বাচন কীভাবে হবে। আমরা শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন চাই না। বিরোধী সব দল মিলে একটা ঐক্য তৈরি হয়েছে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়।”
বিএনপি মহাসচিব হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এবার আর ধান খাওয়া হবে না। বাংলার মানুষ বুঝে গিয়েছে। এবার আর সম্ভব হবে না। এক দফা দাবিতে দেশের সব মানুষ একসঙ্গে জেগে উঠেছে। অন্যথায় পালানোর পথও পাবেন না। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিশ্বাস করি। আমাদের বাধা দেবেন না। এই শান্তির মাধ্যমে আমরা বিজয় যাত্রা আনবো।’
তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘যদি দেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে চান, তাহলে যাদের গ্রেপ্তার করেছেন তাদের এবং (বিএনপি প্রধান) খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীকে অবিলম্বে মুক্তি দিন।’
নতুন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করে ফখরুল বলেন, ‘আমরা আমাদের শরিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবো।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার আহ্বায়ক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে সমাবেশে দলের অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও বক্তব্য রাখেন।
‘অনেক হয়েছে, আর না’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশে অলিখিত বাকশাল কায়েম করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এই সরকার লগি-বৈঠার সরকার। আজকে তারা বলে, তারা দেশে গণতন্ত্র এনেছে। অথচ তারা দেশে এনেছে স্বৈরাচার। এই সরকার আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা দিয়েছে। অথচ আমরা তাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলাও দেইনি। এই সরকার আমাদের মহাসচিবের বিরুদ্ধে ৮৭টি মামলা দিয়েছে। অথচ আমরা তাদের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দেইনি। অনেক হয়েছে, আর না। এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।
‘আওয়ামী গোষ্ঠীর মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘গত ২৮ জুলাই আমাদের এত বড় সমাবেশ দেখে আওয়ামী গোষ্ঠীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। আমরা পাকিস্তান আমলে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার অত্যাচার দেখেছি। কিন্তু এই সরকারের মতো কোনো সরকারকে অত্যাচার করতে দেখিনি। আমাদের গয়েশ্বর রায়কে সাপের মতো পেটানো হয়েছে। সাপকেও মানুষ এভাবে মারে না।’
তিনি বলেন, ‘এই দেশ কারও কাছে ইজারা দেওয়া হয়নি। আপনারা আমাদের সবাইকে মেরে ফেললেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন বন্ধ হবে না। জনগণ আওয়ামী লীগের পতন ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করছে না। ফেরাউন-নমরুদ কেউ টিকে থাকতে পারেনি। শেখ হাসিনাও থাকতে পারবেন না।’
‘শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন’
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আজকের সমাবেশ কোনো আন্দোলন কর্মসূচি নয়। এটা প্রতিবাদ সভা। সময়মতো আন্দোলন কর্মসূচি মহাসচিব ঘোষণা করবেন। সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে। নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নেই। আন্দোলন চলছে, চলমান। শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
গত ২৮ জুলাই বিএনপির সমাবেশে লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বক্তব্যের বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, ‘পুলিশের শর্ত, (মামলায়) দোষী সাব্যস্ত হলে নাকি বক্তব্য রাখতে পারবে না! বাংলাদেশের নেতৃত্ব কে দেবে সেটা বিচার বিভাগ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সিদ্ধান্তে নয়, বাংলাদেশের নেতা কে হবে, সেটার সিদ্ধান্ত দেবে দেশের জনগণ। গত ২৮ তারিখে লক্ষ লক্ষ জনগণ সিদ্ধান্ত দিয়েছে, আন্দোলনের নেতা হলেন তারেক রহমান। জনপ্রিয় নেত্রী হলেন খালেদা জিয়া।’
তিনি বলেন, ‘যারা দেশের বড় বড় নেতা হয়েছেন, সবার বিরুদ্ধে মামলা আছে আর সবাই জেলে গেছেন। নেতা হয়েছেন তিনিই যাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে নেতা হয়েছেন তিনি। সুতরাং আমাদের আন্দোলনের নেতা তারেক রহমান আর নেত্রী খালেদা জিয়া। আমরা আগামী দিনে রাস্তায় থাকবো। বাধাগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে প্রতিবাদ করবো প্রতিরোধ করবো।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘ফল পাঠানো আর খাওয়ানো এটা নাটক। নাটক না হলে টিভিতে দেখানোর দরকার কী বা ভিডিও ছাড়ার দরকার কী? এটা দিয়ে আপনারা মানবিক এটা বোঝাতে চান! আপনারা মানবিক হলে আমাদের কিছু নেতাকে খাওয়াবেন আর অনেককে পেটাতেন না। অনেকের হাত পা ভেঙে দিতেন না। আপনারা মানবিক না, আপনারা নাটকবাজ।’
‘আওয়ামী লীগের অফিসের সামনেই সমাবেশ করবো’
সভাপতির বক্তব্যে আব্দুস সালাম বলেন, ‘আপনারা আজকেও রোদে-বৃষ্টিতে ভিজেছেন। কিন্তু আপনারা কেউই মাঠ ছেড়ে যাননি। আমাদের নেতা তারেক রহমান এক বক্তৃতা দিয়েছেন, এতেই তাদের মাথা খারাপ।’
‘তারা বলে, তারেক রহমানের সঙ্গে কেউ নেই। যদি নাই থাকে তাহলে আইন করে বন্ধ করো কেন? আমরা এখন ধৈর্য্য ধরছি। আপনারা মারলে মার খাচ্ছি। কিন্তু আগামীতে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যখন আপনাদের সঙ্গে মারামারি করবো তখন আওয়ামী লীগের অফিসের সামনেই আমরা সমাবেশ করবো। আওয়ামী লীগ হলো ভুয়া, আর তাদের সঙ্গে যারা আছে তারাও ভুয়া। কোনোভাবেই এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজন হলে জাতিসংঘের অধীনে হলেও নির্বাচন দিতে হবে’, বলেন আব্দুস সালাম।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূইয়া, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের সভাপতি হারুন অর রশীদ, মৎসজীবী দলের সদস্য সচিব আব্দুর রহিম, ওলামা দলের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) ও মহিলা দলের নেতারা
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা