আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বান্দরবান-৩০০ নম্বর আসন ধরে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে নিজেদের কোন্দল মিটিয়ে আসন দখল নিতে তৎপর বিএনপি। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে টানা ছয়বার নির্বাচিত বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হলেও বিএনপির মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, আর কোন দল কাকে সমর্থন দিচ্ছে, তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের বিশ্লেষণের যেন শেষ নেই।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দলের বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচঙ্গ্যা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে রাজনীতির মাঠে ক্লিন ইমেজের কারণে বীর বাহাদুর পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তিনবারের নির্বাচিত সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর এর পর থেকেই রাজনীতির মাঠে আরও সময় দিয়ে, শহর থেকে দুর্গম এলাকায় নজর কাড়া উন্নয়ন, জনগণের আরও কাছে গিয়ে নিজেকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন। আর এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই ষষ্ঠবারের নির্বাচনে ১৭৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে নৌকা প্রতীকে জিতে নেন ১ লাখ ৪৭ হাজার ২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরী পান ৫৮ হাজার ৭১০ ভোট।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মীপদ দাশ বলেন, গত ২৭ মে জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লা দলের একক প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য বীর বাহাদুরের নাম প্রস্তাব করলে সর্বসম্মতভাবে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্যশৈহ্লা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বীর বাহাদুর। তিনি জেলায় এত বেশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন, যার ফলে মানুষ ফের সপ্তমবারের মতো আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে নির্বাচিত করবে।’
এদিকে দলীয় নেতা-কর্মীদের চেয়ে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের ওপর অতিনির্ভরশীলতার কারণে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমছে না, আর এর কারণ হিসেবে সাচিং প্রু জেরীর জামায়াতপ্রীতিকে দায়ী করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। তবে বিএনপি জোটে এখন জামায়াতে ইসলামী না থাকার কারণে রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে সাচিং প্রু মনোনয়ন পেতে পারেন, এমন মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রেজা বলেন, ‘যদি বিএনপি নির্বাচনে যায়, তাহলে যিনি মাঠে ছিলেন এবং আছেন, মামলা খেয়েছেন, যিনি তৃণমূলে জনপ্রিয়, দলের সাথে বেইমানি করেননি, তাকেই দলের প্রার্থী করবে।’
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, সাবেক সভাপতি সাচিং প্রু আর বর্তমান সভাপতি মাম্যাচিং সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরমে। সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের পৃথক নেতৃত্বে দলীয় কর্মসূচি পালন করে। ফলে বিভক্ত হয়ে পড়ছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ততই দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
অন্যদিকে জেলা থেকে বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সময় না দেয়ার কারণে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে জেলা যুবলীগের সম্মেলন না হওয়া, গত বছরের ১৩ অক্টোবর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে পুলু মার্মা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাদ্দাম হোসেন মানিক নির্বাচিত হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়া এবং গত ১০ জুন জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনে সভাপতি মং ওয়াইচিং ও সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহম্মেদ ফাহিম নির্বাচিত হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না হওয়ার ফলে এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনকে ঘিরে উজ্জীবিত নন। এর ফলে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বিরোধিতা ও কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়বেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বীর বাহাদুর।
এদিকে জেলা বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, জেলা-উপজেলাজুড়ে একসময় বিএনপির কর্মী-সমর্থক ছিল প্রচুর, ছাত্রদল আর যুবদল ছিল দলের মূল শক্তি। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের চরম অনৈক্য আর স্বার্থের রাজনীতির কারণে বর্তমানে তাতে ভাটা পড়েছে, যার প্রভাব পড়বে নির্বাচনের মাঠে।
বিষয়টি স্বীকার করে লামা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আমির হোসেন বলেন, ‘জেলা বিএনপিতে সমস্যা আছে, বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা কিছুটা আছে, কিন্তু সাচিং প্রু জেরীকে প্রার্থী দেয়া হলে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসবে।’
বান্দরবান আসনে বিগত সময়ে জনসংহতি সমিতি থেকে প্রার্থী দেয়া বা অন্য দলের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়া হলেও এবার বিভিন্ন মামলার কারণে সংগঠনটির নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকে প্রার্থী কে হবেন, সে বিষয়ে কোনো আভাস নেই। প্রার্থী দেয়া না হলে সংগঠনটির ভোটব্যাংক যাবে বিএনপির দিকে। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) থেকে আগে প্রার্থী হিসেবে ছোটন তংচঙ্গ্যাকে দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতি ছাড়ার কারণে এবার কে প্রার্থী হচ্ছেন, সেই বিষয়ে অনিশ্চিত।
অন্যদিকে জোর গুঞ্জন, জেলায় জাতীয় পার্টির দুটি অংশের রাজনীতি সীমিত আকারে থাকলেও জেলা জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সভাপতি ক্য শৈ অং বা সাধারণ সম্পাদক শওকত জামান মিশু নির্বাচনী প্রার্থী হতে পারেন। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির (বিদিশা) সভাপতি কাজী নাসিরুল আলমকে প্রার্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শওকত জামান মিশু বলেন, ‘দলের প্রার্থী নিয়ে সমস্যা নেই, দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে একজনকে দল মনোনয়ন দেবে।’
এ অবস্থায় জেলার রাজনীতির মাঠের সমীকরণ নিয়ে এখন থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি জমে উঠেছে, সম্ভাব্য প্রার্থীরা হয়ে উঠেছেন তৎপর।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা