একদিকে লেনদেন খরা অন্যদিকে ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে না পারা, সব মিলে সময়টা অনুকূলে নেই পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের।
এমন সময়েও গুজব ছড়িয়ে কিছু কিছু কোম্পানিকে অতি মূল্যায়িত করা হচ্ছে।
বিপরীতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ কাজে আসছে কতটুকু?
পুঁজিবাজারের বর্তমান নিয়ে ‘দৈনিক বাংলা’কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন সিনিয়র রিপোর্টার সুলতান আহমেদ।
আল-আমিন, সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ
প্রশ্ন: আমরা দেখছি, গত দুই সপ্তাহে বাজারে লেনদেন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। পাশাপাশি অল্প করে হলেও কমছে প্রধান সূচকগুলো। অন্যদিকে আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান বলেছেন, বাজারে সুসময় এলেই তুলে নেয়া হবে ‘ফ্লোর প্রাইস’। এখন বিনিয়োগকারীদের মনেও প্রশ্ন সেই সুসময় আসবে কবে?
আল-আমিন: ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি জানেন যে, বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্য স্থির বেঁধে দেয়া রয়েছে। এর অর্থ কোনো শেয়ার সেই সীমার নিচে নেমে লেনদেন করতে পারছে না। এর সুযোগ নিয়েছে একটা শ্রেণি। বাজারে যখন ভালোমানের প্রায় ৮০ ভাগ কোম্পানি আটকে রয়েছে ফ্লোর প্রাইসে তখন দুর্বল শেয়ার নিয়ে সেই শ্রেণিটা কারসাজি করছে। তারা স্মার্ট মানি বা নতুন করে কিছু পুঁজি ঢুকিয়ে কোম্পানিগুলোকে অতি মূল্যায়িত করেছে। এমন হয়েছে যে, ৩৭ টাকার শেয়ার ১৮৮ টাকায় চলে গিয়েছে, ২০ টাকার শেয়ার ৪০ টাকা হয়েছে। মানে হচ্ছে একটা সিগনিফিকেন্ট গ্রোথ হয়েছে। আবার বিমা খাতে দেখেন নতুন নতুন ফান্ড এসেছে, এখানে আমি বলব যদি ভালোমানের কোম্পানি হয় তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তবে যেগুলোর মৌলভিত্তি নেই সেগুলোতে ফান্ড ঢুকলেই বিপদ।
এবার আসি লেনদেনে, কিছুদিন আগেও ১ হাজার থেকে ১২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, এখন সেটা নেমে এসেছে ৫০০ কোটির ঘরে। এই যে ড্রপ ডাউনটা হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে কিছু ফান্ড বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। অন্যদিকে ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগকারীরা চাইলেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। অনেকের অনেক বিপদেও তাদের টাকা ক্যাশ করতে পারছেন না। এই যদি হয় তাহলে বাজারে সুদিন কীভাবে আসবে আমার বোধগম্য নয়। এখন তো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শুধু বিক্রির প্রবণতা দেখি। ফান্ড যদি বের না হয়ে বাজারে থাকে তাহলে এটা সমস্যা নয়, তবে ফান্ড বের হয়ে গেলে তো বাজার ভালো হবে না।
প্রশ্ন: তাহলে লোকসান হওয়ার কারণে ফান্ড চলে যাচ্ছে, নাকি অন্য কোনো কারণ?
আল-আমিন: অবশ্যই। লোকসান হওয়ার কারণে। আপনি কি চাইবেন বিনিয়োগ করে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে? সবাই এখানে আসে কিছু লাভের আশায়। একটা শেয়ার কিনবে সেখান থেকে কিছু লাভ হবে, আবার দু-এক জায়গায় হয়তো লোকসান হবে, এটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে এসব হচ্ছে না, এখনকার বাজারে দেখেন ভালোমানের শেয়ার পড়ে আছে ফ্লোরে। অনেক কোম্পানির ইপিএস, পিই রেশিও ভালো, ডিভিডেন্টও দিচ্ছে ভালো, তার পরও দেখতে পাচ্ছি সেই শেয়ারের মুভমেন্ট হচ্ছে না। কারণ হচ্ছে, বড় বিনিয়োগকারী যারা তারা সেই কোম্পানির সঙ্গে নেই। যারা বাজারে ফান্ডামেন্টাল দেখে বিনিয়োগ করেছেন তারাও এখন হতাশ হয়ে তাদের ফান্ড সরিয়ে নিতে চাচ্ছেন।
যেটা কোনো স্বাভাবিক বাজারের লক্ষণ নয়। আবার দেখেন, যে কোম্পানির নিলাম হচ্ছে, ১০০ কোটি টাকার ওপর দায়-দেনা রয়েছে সেই কোম্পানি ৩৭ টাকা থেকে ১৮৮ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এমন বহু কোম্পানির ক্ষেত্রে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এসব জায়গাতে কোনো সাধারণ বিনিয়োগকারী নেই বরং কোনো চক্র কাজ করছে।
প্রশ্ন: তাহলে এই বাজারে ব্যবসা করছে কারা?
আল-আমিন: আপনি জেনে থাকবেন, বহু ব্রোকারেজ হাউস তাদের কর্মী ছাঁটাই করছে। আবার কেউ কেউ ভালো ব্যবসাও করছে। এর কারণ হলো একই বাজারে ভালো কোম্পানি, ভালো বিনিয়োগকারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। আবার এমন চক্রে যারা আছেন তারা ভালো ব্যবসা করছেন। সে জন্য আমি মনে করি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কারও বিষয়ে কোনো অভিযোগ উঠলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সিদ্ধান্ত দিতেই যদি পাঁচ ছয় মাস লেগে যায়, তাহলে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল। তার ব্যবসা সে করে নিল এই সময়ের মধ্যে, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখানেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
প্রশ্ন: তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের করণীয় কি?
আল-আমিন: ওই যে আগেই বললাম, বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী এখন চাচ্ছে বাজার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে। সেটাও তারা পারছেন না। কারণ চাইলেও তাদের শেয়ার তারা বিক্রি করতে পারছেন না। দেখুন, ফ্লোর প্রাইসে থাকা কোনো শেয়ার যদি ব্লকেও বিক্রি করতে চান তাহলে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকার শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তার মানে ছোটরা চাইলেও তাদের হাতে থাকা ১ লাখ, ২ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। এমন অবস্থায় ধৈর্য ধরা ছাড়া কিছুই করার নেই। ভালোমানের শেয়ারে থাকলে একদিন সেটার দাম বাড়বেই। তখন চাইলে যে কেউ বিক্রি করে বের হতে পারবেন।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি, দুর্বল শেয়ারের লেনদেনও বেশি হচ্ছে। ‘বি’ এবং ‘জেড’ ক্যাটাগরি শুধু দাম বাড়ার শীর্ষে নয়, লেনদেনেও শীর্ষে উঠে আসছে। এর কারণ কি?
আল-আমিন: ওই যে বললাম, চক্র। তারা তাদের অ্যাকাউন্টে শেয়ার কিনে গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে এটা বাড়বে, ওটা বাড়বে। বিনিয়োগকারীরাও দেখে শেয়ারটির দাম কয়েক দিন ধরেই বাড়ছে, তখন বুঝে হোক আর না বুঝে হোক শেয়ার কেনার হিড়িক পড়ে। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে চক্রটি শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যাচ্ছে, দিন শেষে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিতে পড়ছেন। কোনো কোনো শেয়ারের ক্ষেত্রে দেখবেন একটু বাড়লেই ডিএসইর পক্ষ থেকে নোটিশ দেয়া হচ্ছে, আবার কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে বহুগুণ বাড়লেও তা দেয়া হচ্ছে না। এগুলো কেন হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খুঁজে বের করতে হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে কখনোই মানুষের আস্থা ফিরবে না।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা