ভয়ংকর আগস্টের দিকেই এগোচ্ছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নতুন রেকর্ড হয়েছে প্রায় তিন হাজার জন। এ সময়ে মারা গেছেন ১২ জন। দেশে এক দিনে এত ভর্তি রোগী আগে দেখা যায়নি।
এদিকে এতদিন ডেঙ্গুকে শহুরে অসুখ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা এখন আর কেবল শহরে অর্থাৎ ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। এডিস ছড়িয়েছে দেশজুড়ে, যার কারণে পুরো দেশে এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।
খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। আর এ অবস্থায় পুরো দেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কয়েক দিন ধরেই রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাসপাতালের চাইতে সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালে রোগী বেশি হচ্ছে। তবে মৃত্যু কম ঢাকার বাইরে।
বৃহস্পতিবার চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গু রোগীর নতুন রেকর্ড হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এদিন জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৯৭ জন আর ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৬২ জন।
আগের দিন (৯ আগস্ট) হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ছিলেন ২ হাজার ৮৪৪ জন। তার মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ৯২ জন আর সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হর ১ হাজার ৭৫২ জন। তার আগের দিন ৮ আগস্ট ২ হাজার ৭৪২ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ২ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ১ হাজার ৭৪০ জন, ৭ আগস্ট ২ হাজার ৭৫১ জনের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের হাসপাতালে ১ হাজার ১১৯ জন, বাইরে ১ হাজার ৬৩২ জন, ৬ আগস্ট ২ হাজার ৭৬৪ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ৭৮ জন, বাইরের হাসপাতালে ১ হাজার ৬৮৬ জন, ৫ আগস্ট ২ হাজার ৪৯৫ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ৬৯ জন আর বাইরের হাসপাতালে ১ হাজার ৪২৬ জন, ৩ আগস্ট ২ হাজার ৫৮৯ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ১০১ জন, বাইরের হাসপাতালে ১ হজার ৪৮৮ জন, ২ আগস্ট ২ হাজার ৭১১ জনের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ১৩০ জন, ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ১ হাজার ৫৮১ জন আর ১ আগস্টে ২ হাজার ৫৮৪ জনের ভেতর ঢাকার হাসপাতালে ১ হাজার ১৩১ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৪৫৩ জন।
তবে কেবল আগস্টই নয়, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে মূলত ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রোগী বাড়তে শুরু করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৭৮ হাজার ২৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৯ হাজার ৯১১ জন আর ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮ হাজার ১১৭ জন। অর্থাৎ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালেও ঢাকার সমানতালে রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যু বেশি। অধিদপ্তর জানাচ্ছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৩৬৪ জনের মৃত্যু হলো। তাদের মধ্যে ২৮৩ জন সিটি করপোরেশনের ভেতরে। আর সিটি করপোরেশনের বাইরের হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ৮১ জনের।
এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়। ওই বছরে ২৮১ জনের মৃত্যুর কথা জানায় অধিদপ্তর। কিন্তু চলতি বছরের ৩ আগস্ট সে রেকর্ড ভেঙে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৯ হাজার ৭৯০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে রয়েছেন ৪ হাজার ৪৬০ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে রয়েছেন ৫ হাজার ৩৩০ জন। ঢাকার হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছেন ৮৮ শতাংশ আর ঢাকার বাইরে থেকে ছুটি পেয়েছেন ৮৬ শতাংশ রোগী; অর্থাৎ ঢাকার বাইরের হাসপাতালের রোগীদের ছুটি পাওয়ার শতকরা হার কম।
ডেঙ্গুর এই জরুরি অবস্থায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১০টি সুপারিশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীর মহাখালীর নিপসম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: সামনে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তারা সুপারিশের কথা বলেন।
১০ সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ানো, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল উদ্যোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু, মশারি বিতরণ, মশার ওপর নিয়মিত নজরদারি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গোটা সরকারব্যবস্থার সম্পৃক্ততা এবং জোরালো তদারকি ও নিয়মিত কাজের মূল্যায়ন।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি নানা পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। কিন্তু বর্তমান দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে না যে আমরা একত্রে আছি। নির্বাচনের কারণে ডেঙ্গু ইস্যুটি পেছনে পড়ে গেছে। এতে দুর্যোগ আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।’ বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। বর্তমানে ডেঙ্গু জাতীয় জরুরি অবস্থার মতো।
আর সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে দেখা যায়নি। জরুরি অবস্থার জন্য হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে হবে, বিষয়টি তেমন নয়।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা