আপডেট : ১১ আগস্ট, ২০২৩ ০৯:১৪
বিকল্প চিনি কি স্বাস্থ্যসম্মত?
ড. মো. মারুফুর রহমান

বিকল্প চিনি কি স্বাস্থ্যসম্মত?

দুই দিন আগে বাজার করার সময় সফট ড্রিংক্স কর্নারের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো চিনি ছাড়া ড্রিংকগুলোতে কী কী উপাদান আছে দেখি। সারা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত তিনটি জনপ্রিয় নন সুগার সফট ড্রিংকেই দেখলাম সুগার সাবস্টিটিউট হিসেবে এসপারটেম দেয়া আছে (ছবি ১-৩)। এ বছর জুন মাসের শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার IARC (International Agency for Research on Cancer) এবং FAO ও WHO-এর জয়েন্ট কমিটি JECFA এসপারটেম কে গ্রপ-২বি উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে যার অর্থ হলো এটি ‘সম্ভবত’ মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান। সম্ভাব্য বলার কারণ, এসপারটেম ক্যানসার তৈরি করে এমন কথা বলার মতো শক্তিশালী প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে কিছু প্রাণীদেহে ও মানবদেহের ক্ষেত্রেও কিছু প্রমাণ আছে, আরও গবেষণা প্রয়োজন। গ্রুপ ২বি-তে অন্তর্ভুক্ত আরও কিছু উপাদান হলো সিসা, গ্যাসোলিন/পেট্রোল ইঞ্জিন থেকে নির্গত ধোঁয়া, ওয়েল্ডিংয়ের ধোঁয়া ইত্যাদি। তাদের এই ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে এবং আমেরিকান ফুড রেগুলেটরি সংস্থা FDA ও ইউরোপিয়ান সংস্থা EFSA বলেছে বাজারে বিভিন্ন খাবারে যেটুকু পর্যায়ের এসপারটেম পাওয়া যায় সেটা মানবদেহে নিরাপদ।

ব্যাপারটা অনেকটা রাজায় রাজায় যুদ্ধে উলুখাগড়ার প্রাণ যাওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একসময় সিগারেটকেও নিরাপদ ভাবা হতো এবং চিকিৎসকদের সিগারেটের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হতো। ওপর মহলে যুদ্ধ চলুক, খাবেন কি খাবেন না, সেই সিদ্ধান্ত আপনার। তবে খাবার আগে জেনে নিন এ-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণা কী বলে।

এসপারটেম ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান হতে পারে এ ব্যাপারটি প্রথম ইঁদুরে পরীক্ষা করে দেখা হয় ২০০৬-০৭ সালে। দেখা যায়, বাজারে যে মাত্রায় খাবারে এসপারটেম পাওয়া যায়, সেই মাত্রাতেই ইঁদুরে ক্যানসার সৃষ্টি হচ্ছে।

গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ২০২১ সালে আরেক দল বিজ্ঞানী আবারও প্রমাণ করেন এসপারটেম ইঁদুরে ক্যানসার ঘটাতে পারে। মানবদেহে এসপারটেম নিয়ে সবচেয়ে বড় গবেষণা হয় ২০০৯-২১ সালজুড়ে। ১ লাখের বেশি ফ্রেঞ্চ জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায় কন্ট্রোল গ্রুপ (যারা খায়নি) এর তুলনায় এসপারটেম গ্রহণকারীদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ১ দশমিক ১৫ গুণ এবং এসাল্ফেম-কে গ্রহণকারীদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ১ দশমিক ১৩ গুণ বেশি। যদিও ঝুঁকির পরিমাণ সংখ্যা বিচারে সামান্য। কিন্তু ঝুঁকি আছে এটি নিশ্চিত। মূল গবেষণাপত্রের লিংক: https://shorturl.at/hlBHT.

ক্যানসার ঝুঁকি ছাড়াও আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার এবং প্রাকৃতিক নন সুগার সুইটেনার (স্টেভিয়া) ওজন কমানোর জন্য উপযোগী নয়। বরং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন রেজিস্টেনসের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন প্রকাশিত হয়েছে এ বছর মে মাসে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, এসব বিকল্প চিনি খেলে মুখে মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। ফলে শরীর ইনসুলিন নিঃসরণ করে। কিন্তু সেই ইনসুলিন কাজে লাগানোর মতো গ্লুকোজ রক্তে নেই, তাই ক্রমান্বয়ে ইনসুলিন রেজিস্টেনস (ইনসুলিন শরীরে কাজ না করা) বাড়তে থাকে।

এ ছাড়া এই মিস্টি স্বাদ শরীরের কিছু সুইট টেস্ট রিসেপ্টরের (TR-1 ও TR-2) মাধ্যমে ফ্যাট টিস্যু তৈরির সিগন্যাল দেয়। ফলে আরও ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে এই বিকল্প চিনি আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্রে অবস্থিত উপকারী জীবাণুদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে সেখান থেকে নির্গত কিছু কেমিক্যাল (LPS, SCFA) প্রদাহ তৈরি করে এবং প্যানক্রিয়াসকে সিগনাল দেয় আরও ইনসুলিন তৈরি করতে। পরিপাকনালিকে সিগনাল দেয় আরও চিনি শোষণ করতে। সব মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ইনসুলিন রেজিস্টেনস ও চর্বি জমার প্রবণতা তৈরি হয়।

চিনি খারাপ, তবে চিনির বিকল্পগুলোও ভালো নয়। তথ্য উন্মুক্ত, নিজেরাই বিবেচনা করুন কী খাবেন, কতটুকু খাবেন, কীভাবে খাবেন এবং খাওয়ার পর প্রভাব কমাতে কী করবেন। সুস্থ থাকার জন্য সুষম খাদ্য ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

লেখক: চিকিৎসক ও ক্যানসার গবেষক, দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য