আপডেট : ১২ আগস্ট, ২০২৩ ১১:১৪
ইফাজের স্বপ্ন সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ
মাহফুজ নান্টু, কুমিল্লা

ইফাজের স্বপ্ন সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ

হাতে সাইকেল নিয়ে ভারতের লাদাখে মাহমুদুল হাসান ইফাজ। ছবি: সংগৃহীত

‘ছোটবেলা থেকে আব্বুর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনেক গল্প শুনেছি। তিনি টানা ৭২ ঘণ্টাও সাইকেল চালিয়েছেন। আব্বুর এমন গল্পগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। যখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করি, তখন থেকেই আমার একমাত্র বাহন সাইকেল। আমার ইচ্ছা হতো আমি সাইকেল নিয়ে দূর-দূরান্তে হারিয়ে যাই।’

সাইকেলে ভ্রমণ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করেন মাহমুদুল হাসান ইফাজ। ইফাজ কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বানাশুয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে। তার বাবা একটি হজ ট্রাভেল এজেন্সির গাইড হিসেবে নিয়োজিত আছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইফাজ ছোট। বড় ভাই ইথার একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সময় দেন। হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করা ইফাজের সব স্বপ্ন সাইক্লিং নিয়ে।

মাহমুদুল হাসান ইফাজ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে সাইকেল নিয়ে আমার পাগলামি শুরু। একবার পাগলামি এমন পর্যায়ে চলে এসেছিল যে আমাকে আমার পরিবার মাদকাসক্ত মনে করে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে দিয়ে আসে। তবুও আমি দমে যাইনি। সাইকেল চালিয়েছি। শুধু আমার দেশেই নয়; পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সীমান্ত জেলাগুলো ঘুরেছি, দেখেছি। দেখেছি তাদের বৈচিত্র্যময় জীবন। আমার স্বপ্ন সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করা।’

ইফাজের বর্ণনায় উঠে আসে তার সাইক্লিং জীবনের কথা। জিপিএস ট্রাকিং অ্যাপ স্ট্রাভাতে রেকর্ড আছে ৬২ হাজার কিলোমিটার সাইকেলে ঘুরে বেড়ানোর তথ্য। বাকি তথ্যগুলো গুগল ড্রাইভে সেভ করে রেখেছেন। সাইকেলের এমন নেশায় ভয়ংকর সব কাজ করেছেন ইফাজ। সেগুলোর বর্ণনা ছিল লোমহর্ষক।

২০১৪ সালের ঘটনা। ভারতের কলকাতা থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি সাইকেল র‌্যালি হবে। এমন তথ্য শুনেই ইফাজ রওনা করলেন একটি ফনিক্স সাইকেল নিয়ে। তার ভিসা পাসপোর্ট নেই। তবুও সে ওই র‌্যালিতে অংশগ্রণ করবেন। বাড়ি থেকে টানা দুই দিন সাইকেলে চড়ে বেনাপোল বন্দরে উপস্থিত হন। তবে পাসপোর্ট-ভিসা না থাকায় বন্দর দিয়ে ওপারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সাইকেল কাঁধে নিয়ে নদী সাঁতরে ভারতে যান। তবে নদীর চরে ডাকাতের কবলে পড়েন। সে সময় বহু কষ্টে রক্ষা পান।

ভারতে সাইকেল র‌্যালি যারা আয়োজন করেছেন তারা ইফাজের মুখে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা ভ্রমণের গল্প শুনে খুবই অবাক হন। একটা ছেলের সাইকেল নিয়ে এমন প্যাশন আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। সেবার ইফাজ ভালোভাবে সাইকেল র‌্যালি সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে আসেন।

সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বহু দিন বাড়িতে না ফেরার ঘটনাও ঘটেছে। বাবা-মায়ের বকুনি শুনতে হয়। এখনো এমনই ঘটে। তবে ইফাজের এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সাইক্লিংয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন।

গেল মাসেই ইফাজের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। মন খারাপ হয় ইফাজের। সাইকেল চুরির ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকে জেনে ইফাজকে সান্ত্বনা দেন। পরে সাইক্লিস্টদের সহায়তায় চোরকে শনাক্ত করে সাইকেলটি উদ্ধার করতে সমর্থ হন। সাইকেল নিয়ে ইফাজের এমন বহু ঘটনা আছে। সেসব বাদে ইফাজ বড় করে দেখেন তার সাইকেল নিয়ে চড়ে বেড়ানোর কথা।

ইফাজ বলেন, একদিনে তিনি টিম বিডিসির সঙ্গে বিরতিহীন ৫০০ কিলোমিটার সাইকেল ভ্রমণ করেছেন। ঢাকা থেকে তার যাত্রা শুরু হয়। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থেকে শেরপুর তারপর কিশোরগঞ্জ হয়ে আবার ময়মনসিংহের ভালুকায় ফিরে আসেন। বিরতিহীন এমন সাইক্লিং বাংলাদেশে খুব একটা হয় না বলেও জানান তিনি।

ইফাজ জানান, বাংলাদেশের সব কটি জেলাতেই ঘুরেছেন তিনি। সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি তিনি শতবর্ষী বৃক্ষ রক্ষা ও ইয়ুথ অ্যাগেইনস্ট ড্রাগ এই দুইটা ম্যাসেজ পৌঁছে দেন। এভাবে সাইক্লিং করতে গিয়ে ২০১২ সালে যোগ দেন বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের সঙ্গে। পরে তার সাংগঠনিক দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার কারণে স্থানীয় কমিউনিটি সংগঠন কুমিল্লা সাইক্লিস্ট গ্রুপের অ্যাডমিনের দায়িত্ব পালন করছেন।

চলতি বছর টানা ৪২ দিন সাইকেলে ভারতের ৫টি রাজ্য ভ্রমণ করেছেন ইফাজ। যার মধ্যে ত্রিপুরা, মিজুরাম, আসাম, মেঘালয় এবং পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে। সেখানে সাইকেল ভ্রমণের সময় সাধারণ মানুষের মন উজাড় করা ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি।

একযুগের সাইক্লিংয়ে ইফাজের ঝুড়িতে কিছু অর্জন যোগ হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় সাইকেল রেসে পুরস্কার পেয়েছেন, ভারতের লাদাখে অনুষ্ঠিত এমটিভি ডোয়াথলন সার্টিফিকেট অর্জন, দীর্ঘতম চলমান বাইসাইকেল সিঙ্গেল লাইনে অংশগ্রহণ করে গিনেস সার্টিফিকেট অর্জন করেন। পরে আবারও টিম বিডিসির সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টায় রিলে সর্বোচ্চ সাইক্লিংয়ে ১৬৭০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গিনেস সার্টিফিকেট অর্জন করেন। এ ছাড়া বিডি সাইক্লিস্ট হল অব ফেম সার্টিফিকেট অর্জনসহ আরও কিছু সার্টিফিকেট ও সম্মাননা পেয়েছেন।

সাইক্লিং নিয়ে ইফাজ তার স্বপ্নের কথা বলেন। এক যুগের এই নেশা নিয়ে এখন বিশ্ব ভ্রমণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। সে জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পান তা হলে একদিন তিনি বাংলাদেশের মানচিত্র বিশ্বের বুকে তুলে ধরবেন।

ইফাজ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন, যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন-পরিবেশ রক্ষণ নিয়ে সচেতনতা প্রচার, বৃক্ষরোপণ ও রক্তদান উল্লেখযোগ্য।