আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে নিয়ে নানা খেলা চলছে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই এলাকাটাকে নিয়ে নানা ধরনের খেলার একটা চক্রান্ত। যেহেতু আমি জানি, আমি বুঝি যে কারণে কীভাবে আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাবে। তাদের কিছু কেনা গোলাম আছে, পদলেহনকারী আছে তাদের বসিয়ে এই জায়গাটাকে নিয়ে খেলবে। সেটাই হচ্ছে প্রচেষ্টা। সেটা আমি ভালোভাবে বুঝতে পরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, বিএনপি তাদের চোখের মণি। তাদের নিয়ে ক্ষমতায় বসাতেই হবে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বুধবার এক স্মরণসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, সব থেকে অবাক লাগে। যে সব দেশে এই খুনিদের (বঙ্গবন্ধুর) আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে। তারা যখন আমাদের কাছে এসে মানবাধিকারের কথা বলে। তারা নির্বাচনের কথা বলে, স্বচ্ছতার কথা বলে। তারা যেন এখন খুবই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একেবারে উতলা হয়ে পড়েছে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ২০০১ সালের নির্বাচনে এদেশে নির্বিচারে অত্যাচার চললো। কত মানুষকে খুন করেছে। হাত কেটেছে। চোখ তুলে নিয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে। তখন নির্বাচন নিয়ে কোন কথা হয়নি কেন? সেই নির্বাচনে তো আমাদের হারার কথা নয়। সে নির্বাচনে তো জোর করে আমাদের হারানো হয়েছে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটার বিহীন নির্বাচন করে ছিলো তখন তাদের নির্বাচনী চেতনা কোথায় ছিলো? জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের সময় ৪৮ ঘন্টা ভোটের ফল বন্ধ করে রেখে ফল ঘোষণা করে সেটা নিয়ে তো এদের কোন উদ্বেগ তো আমরা দেখিনি। আজকে তাদের কাছ থেকে নির্বাচনের কথা, মানবাধিকারের কথা আমাদের শুনতে হয়। তো আমাদের মানবাধিকার কোথায় ছিলো যেখানে আমরা বাবা মায়ের হত্যার বিচার চাইতে পারতাম না। হত্যার বিচার চেয়ে একটা মামলা করার অধিকার আমাদের ছিলো না।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ১৯৮৮ সালে এরশাদের নির্বাচনের সময় তো তাদের উদ্বেগ দেখিনি। হঠাৎ এবারের ইলেকশনের সময় যেন খুউব বেশি উতলা হয়ে পড়লো। নির্বাচনের একেবারে দাড়ি, কমা, সেমিকোলন, কোথায় কী? কীভাবে হবে তাই নিয়ে সব থেকে বেশি এবং একের পর এক তাদের লোকজন আসা শুরু করলো। কেন? কারণটা কী? আর বিএনপি এখন তাদের চোখেন মণি। যে বিএনপি এত মানুষ হত্যা করেছে। জাতির পিতার হত্যার সাথে জড়িত। তারা কয়দিন আগেও আগুন দিয়েছে। ২০১৩, ১৪ ও ১৫ তে অগ্নি সন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করলো। কিছুদিন আগেও তো পুলিশের গাড়িতে আগুন। পুলিশের ওপর আক্রমণ। তো পুলিশ কী বসে বসে মার খাবে? জাতীয় সম্পদকে নষ্ট করা। এদেশে একটার পর একটা ধ্বংসযজ্ঞ চালালো আজকে তাদের নিয়ে মাতামাতি।
অনেক কিছু সহ্য করেছি: বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসতে হবে এমন প্রস্তাবের ইঙ্গিত দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, তাদের সাথে বসতে হবে। তাদের সাথে কথা বলতে হবে। অনেক বলেছি। জানি খুনি। শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, পিতার স্বপ্ন পুরণের জন্য অনেক কিছু সহ্য করেছি। দেশের জন্য কাজ করেছি। কিন্তু আজকে দেখি এত বেশি নির্বাচন নিয়ে কথা। যখন আমরা আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। খালেদা জিয়ার সেই আজিজ মার্কা বা সাঈদ মার্কা নির্বাচন কমিশন তো না। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার নিয়ে ইলেকশন করার চেষ্টা করেছে তখন এত চেতনা আমরা দেখিনি। এত কথাও শুনিনি। বাংলাদেশের এই উন্নয়নটা এটা বোধহয় তাদের পছন্দ নয়। অগ্রযাত্রাটা তাদের পছন্দ নয়।
তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন বা গণতন্ত্র নয়: যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির জন্য উতলা হয়ে গেছে এমন ইঙ্গিত দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, যে বিএনপি সন্ত্রাসী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, যাদের হাতে আমার বাবা-মা ভায়ের রক্তের দাগ। হাজার হাজার কর্মীর রক্তের দাগ। তাদের জন্য তারা উতলা হয়েছে। আজ তাদের নিয়ে ক্ষমতায় বসাতেই হবে। আসলে ক্ষমতায় বসানো নয়। এদের উদ্দেশ্য এখানে নির্বাচন নয়, এদের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র নয়। এরা একটা জিনিসই করতে চায়- আজকে যে আমরা গণতন্ত্রের ভীত মজবুত করেছি। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছি। বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে। দারিদ্রের হার কমছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়।
এ অঞ্চল ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করতে চায়: বাংলাদেশসহ এ অঞ্চল ভৌগলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে ভারত মহাসাগর অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। এই ভারত মহাসাগরে কিন্তু আমাদের বে অব বেঙ্গল। এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাচীন যুগ থেকে এই যায়গা থেকে সকল ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। এই জায়গাটা ভারত মহাসাগরে যতগুলি দেশ আছে তার কারো সাথে কোন দ্বন্দ্ব নেই। সম্পূর্ণ নিষ্কন্টক একটা যোগাযোগ পথ। এই জলপথ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে সব থেকে নির্বিঘ্নে এখান থেকে পণ্য পরিবহন হয়। আজকে আমাদের গণতন্ত্রের নাম নিয়ে, নির্বাচনের নাম নিয়ে, নানা নাম নিয়ে এই দেশে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করতে চায়, যাতে করে ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর। এই জায়গাটাকে ব্যবহার করা। আর এটাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করা এবং দেশগুলিকে ধ্বংস করা। এটাই হচ্ছে কারো কারো উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু এদের নানা ধরণের টালবাহানা। এটা দেশবাসীকে বুঝতে হবে।
এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী তাদের সাথে সুর মেলাচ্ছেন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কিছু আতেঁল আছে। দুটো পয়সার লোভে তারা নানাভাবে এই কাজগুলি করে বেড়ায়। এ বিষয়ে আমাদেরকে যেমন সজাগ থাকতে হবে। তাছাড়া অন্যান্য দেশ- আমি তো বলবো ভারত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন আছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
দেশের উন্নতিতে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে: দেশপ্রেমী নাগরিকদের এ ব্যপারে সচেতন থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের এতটুকু ক্ষতি করে কোনদিন ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা আমি করি না। আজকে যখন দেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছি তখনই সকলের মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া জড়িত: বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার প্রসঙ্গে টেনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, যারা আমাদের বাড়িতে উঠাবসা করেছে, সব সময় খাওয়া-দাওয়া করেছে তারাই বেইমানী করেছে। সংবিধান অনুসরণ না করে খুনি মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলো। জিয়াউর রহমানকে বানালো সেনাপ্রধান। এই ষড়যন্ত্রের সাথে তো জিয়াউর রহমান ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এটা তো বাস্তবতা। তবে বেইমানী করে মোশতাককে মীর জাফরের মত বিদায় নিতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পর জামায়াত সর্বহারা পার্টি ও জাসদে যুক্ত হয়েছিল: জামাতের উত্থান জিয়াউর রহমানের হাতে এমন দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, এই জামাত, এরা ছিলো যুদ্ধাপরাধী। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যে সংবিধান দিয়েছিলেন সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন, যেমন কোন ভোটাধিকার ছিলো না। তাদের দল করবার অধিকারও ছিলো। তাদের অনেকে তো পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে সেখানে যায়। কেউ কেউ বিদেশে চলে যায়। আর দেশে যারা ছিলো তারা সকলেই আন্ডার গ্রাউন্ডে যে সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি- বিভিন্ন পার্টির সাথে ভিড়ে যায়।
তিনি বলেন, সেই সময় ছাত্রলীগ ভেঙ্গে যে জাসদের সৃষ্টি হয়। এই জাসদের সাথে এরা যুক্ত হয়ে যায়। যে কারণে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে জাসদ যে বড় বড় মিটিং করতো টাকা পয়সার অভাব হতো না। যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো এরপর তাদের (জাসদের) গুরুত্ব কমে গেল। তখন তাদের লোকও নেই। অর্থও নেই। কারণ রাজাকারা সুযোগ পেয়ে গেল।
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ: প্রধানমন্ত্রী বলেন, মার্শাল ল দিয়ে অবৈধভাবে যে ক্ষমতা দখল এবং ৫ম ও ৭ম সংশোধনী বাতিল করে দিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ উচ্চ আদালত বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অন্তত মুক্তি পেয়েছে এখান থেকে। মানুষ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলো বলেই সংবিধান সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হই।
স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কামরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য তারানা হালিম প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুল আউয়াল শামীম।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা