আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা সরকার সংলাপে বসবে কি না, তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা আছে। সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে সংলাপের বিষয়ে খুব বেশি জোর যেমন দেয়া হচ্ছে না, তেমনি নাকচও করা হচ্ছে না।
অন্যদিকে রাজনীতির মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা সংলাপে বসলেও সরকারি দলের সঙ্গে সংলাপে বসার বিষয়ে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিকরা মনে করছেন, সংলাপে বসা নিয়ে দুই দল যা-ই বলুক না কেন, এখনো সংলাপে বসার মতো পরিস্থিতি বা সময় তৈরি হয়নি।
সরকারদলীয় সূত্র মনে করছে, তারা আগ বাড়িয়ে বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানালে রাজনীতিতে কিছুটা হলেও সুবিধা পেয়ে যেতে পারে বিরোধীরা। এতে নিজেদের দুর্বলতাও প্রকাশ পেতে পারে বলে মনে করেন এই নেতারা। একই অবস্থা বিএনপির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারাও আগ বাড়িয়ে কিছু না বলে দর-কষাকষির জন্য আপাতত চুপ থাকতে চাইছে। তাদের ধারণা, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে পারলে সরকারই তাদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানাবে। তখন দর-কষাকষিতে সুবিধা হবে।
এদিকে বিএনপিকে এ সুবিধা দিতে চায় না ক্ষমতাসীন দল। তারা ইতিমধ্যেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দলের শরিক দলগুলো এবং মহাজোটে থাকা অন্য বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। জোটকে ধরে রেখেই যে তারা নির্বাচন করবে, এটা নিশ্চিত করেছেন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। আর রাজপথে পুলিশ আর ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের দাপটে অনেকটা অসহায় বিএনপি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর আন্দোলন নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত।
গত ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের এক আলোচনায় দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে সংলাপের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। বিএনপির মিছিল-সমাবেশে বাধা না দিতে নিজের নির্দেশের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি তো বলে দিয়েছি তারা (বিএনপি) যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে আসে, পুলিশ যেন বাধা না দেয়। বিশেষ করে বাংলামোটরে যে বাধা দেয়া, সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আসুক না হেঁটে হেঁটে, যতদূর আসতে পারে। কোনো আপত্তি নেই। আমি বসাব, চা খাওয়াব। কথা বলতে চাইলে শুনব।’
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই উদারতাকে বিএনপি দর-কষাকষির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বিএনপি সংলাপের পরোক্ষ ইঙ্গিতের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে অন্য কিছু হাসিল করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বিএনপি রাজপথে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সংলাপ রাজনীতির অংশ। আমি মনে করি সবাই যদি আগ্রহী থাকে তাহলে সংলাপ হওয়া উচিত।’
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকা হবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সময় তো নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ একটু কমই হচ্ছে। করোনা দেখা দিচ্ছে। করোনার কারণে এবার হয়তো একটু চিন্তা করতে হবে। অনেকে আসবে না, আসতেও পারবে না। এটা একটা সমস্যা। নির্বাচনে অংশ নেয়া যেকোনো রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত। কে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, কে করবে না- সেখানে কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অবশ্যই চাই সব দল অংশগ্রহণ করুক। গতবার সবার সঙ্গে আলোচনা করলাম। নির্বাচনে আসার পর দেখা গেল ৩০০ সিটে ৭০০ মনোনয়ন দিয়ে যখন নিজেরা হেরে গেল, তখন সব দোষ কার? আমাদের।’
এ বিষয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনা নেই। ৯৬ থেকে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশ করোনামুক্ত। গণভবনে এখনো করোনা রয়ে গেছে শুনে আশ্চর্য হচ্ছি।’
এলডিপি সভাপতি আরও বলেন, ‘গত নির্বাচনে ড. কামাল হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি। বিএনপিকে খপ্পরে ফেলে গণভবনের দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা এই সরকারকে বৈধ মনে করি না। তাই তাদের বসার বিষয়ে আমাদের ভিন্নমত রয়েছে।’
এদিকে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সংলাপ বিরোধীদের সঙ্গে হবে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুযোগ নেই। সংলাপ করছি তাদের সঙ্গে, যারা এই সরকারকে মানে না। যারা মনে করে এই সরকার দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে; তাদের সঙ্গেই সংলাপ করছি।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের কোনো সুযোগ নাই, প্রশ্নই ওঠে না। তাদের চলে যেতে হবে। চলে গিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দিতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাজ করবে।’
বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্য ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে রাজনৈতিক দর-কষাকষি হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তারা মনে করছেন, বিএনপি মূলত নিজেদের কর্মীদের চাঙা রাখার জন্য রাজনীতির মাঠে বড় বড় কথা বলে পরিস্থিতির উষ্ণতা নিতে চাচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য নিজেদের অবস্থানের জানান দিচ্ছে তারা। সংলাপের জন্য দরজা সব সময় খোলা আছে। সংলাপে বসার আগে বিএনপিকে সংবিধানের ভেতরে থেকে এজেন্ডা ঠিক করতে হবে। রাজনৈতিক মাঠকে উত্তপ্ত করা এবং ঔদ্ধত্য দেখানো বন্ধ করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একজন নেতা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি। নির্বাচন নিয়ে এখনই বসতে হবে, কথা বলতে হবে, এমন কোনো পরিস্থিতি বা বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়নি। নির্বাচনে অংশ নিতে বা কিছু বিষয়ে জানার প্রয়োজনে বিরোধীরা যদি মনে করে, সে বিষয় তো তারা জানতেই পারে। তারা যদি মনে করে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন, সেটাও তারা করতে পারেন। কিন্তু সেটার একটা প্রক্রিয়া আছে এবং নির্দিষ্ট সময় আছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সংলাপটা বিলাপে পরিণত হয়েছে। কোনো সচেতন মানুষ বিলাপ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আগ্রহ দেখাবে বলে বিশ্বাস করি না। এখানে আলোচনা আর সংলাপ কখনোই হবে না, হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সংলাপের বিকল্প নেই। যে পরিস্থিতি চলছে তাতে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি একা কিছুই করতে পারবে না। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস, শ্রদ্ধাহীনতার পাশাপাশি কথায় আর কাজে মিল নেই। বিরোধীরা সরকারপক্ষের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা