দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন শিবিরে চলছে প্রস্তুতিমূলক তৎপরতা। ভোটের আগে বিরোধীদের মোকাবিলা, ভোটকে কেন্দ্র করে বিদেশিদের পক্ষে আনা, উন্নয়ন প্রচারে গুরুত্বারোপ করে ভোট টানার পাশাপাশি দলের কোন্দল নিরসনে ত্যাগীদের মূল্যায়নের চেষ্টা আওয়ামী লীগে। দলটির নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগে কোন্দল থাকলেও জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তা নিরসন হয়ে যাবে। তার কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা অমান্য করবেন না।
আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী বছর ক্ষমতার ১৫ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে দলের। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে পাওয়া না-পাওয়ার বেদনা। একই সঙ্গে বিগত দুই নির্বাচনে একচ্ছত্র বিজয়ী হওয়ায় দলটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আর তাতেই দলীয় কোন্দল রূপ নিয়েছে বড় আকারে। একই আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজের প্রার্থীকে জয়ী করার চেষ্টা ও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে বলয় সৃষ্টি করার প্রতিযোগিতা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, তৃণমূল যে কথা বলেছে, সেটা সঠিক। পৃথিবীর কোন রাজনৈতিক দল আছে সেখানে কোন্দল নেই? এসব কোন্দল নির্বাচনকে ঘিরে। প্রতিটি আসনে ১০ জনের বেশিই প্রার্থী আছে। কিন্তু সবাই নেত্রীর কাছে বলেছেন, তিনি যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষে কাজ করবেন। আমরা আশা করি, সবাই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন। যদি তা না করেন তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, দলের নেতা-কর্মীদের কাজ হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন ও অপকর্ম তুলে ধরা। কিন্তু তা না করে অনেকেই নিজ দলের জনপ্রতিনিধিদের নামে বদনাম ছড়ান। এমপির বিরুদ্ধে বিষোদগার, সমালোচনা প্রকারন্তরে দলের ও সরকারের সমালোচনা। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে ও জনগণের পাশে থাকতে হবে। প্রার্থী নয়, দলের পক্ষে, নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে মানুষের দরজায় যেতে হবে। যোগ্যতা, দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার ওপরই নির্ভর করবে মনোনয়ন। সমালোচনা-বিষোদগার করে মনোনয়ন পাওয়া যাবে না।
দলীয় কোন্দল নিরসনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। ওই সূত্রের তথ্যমতে, দলের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের উদ্দেশে দলীয় প্রধান বলেছেন, দলের দুঃসময়ের যারা ছিলেন, যারা দলের জন্য নানা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের বাদ দেয়া যাবে না। একই সঙ্গে পুরোনো কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদেরও যেন কমিটিতে রাখা হয়।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলায় দলের পাশাপাশি জোটকে সক্রিয় করা হয়েছে। দলীয় কর্মসূচির পাশাপাশি সরকারি কর্মসূচিও বাড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ প্রধান। এ ক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে গত ১৫ বছরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার ও আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এলে কী কী করবে তা তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সর্বজনীন পেনশন ঘোষণা করেছে সরকার। এই পেনশন ব্যবস্থাকে আগামী নির্বাচনের ভোট সংগ্রহে কাজে লাগাতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কাজ চলমান রয়েছে। বিগত দিনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে তার একটা চিত্র ইশতেহারে থাকবে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে সে ঘোষণাও নির্বাচনী ইশতেহারে থাকবে। নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ রক্ষা করে।’
জানা গেছে, আগামী নির্বাচনের প্রচারে জোরেশোরে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জন তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দলের নেতাদের ঘরে ঘরে গিয়ে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের সুফল প্রচার করতে বলেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, আগামী ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করা হবে। ওই দিন ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগ সুধী সমাবেশের আয়োজন করবে। যেখানে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিকদের বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। যারা সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরবেন। এ কারণে আগামী ২ সেপ্টেম্বর সিলেটে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জনসভা স্থগিত করা হয়েছে। এ জনসভা পরবর্তী সময় হবে। সেই সময় খুলনা ও কুমিল্লা জনসভা করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরপর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় সমাবেশ করবেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। ওই তৎপরতায় ক্ষমতাসীন দল চাপের মধ্যেও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কূটনীতিকরা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও বিরোধীদের দাবির পক্ষে কোনো কথা বলছেন না। আর এই বিষয়টিকেই স্বস্তির জায়গা হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের মতে, কূটনীতিকরা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছেন, যেটা আমাদেরও চাওয়া। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কূটনীতিকরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা শেখ হাসিনার পদত্যাগ চান না।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার বিষয়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সে ক্ষেত্রে দলের ও সরকারের বিভিন্ন অংশ কাজ করছে। পাশাপাশি সরকারের মিত্র ও আওয়ামী লীগের মিত্রদের কাজে লাগানো হয়েছে। সংবিধান সমুন্নত রেখে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে ঘুরেফিরে সামনে আনাই ক্ষমতাসীনদের বড় কৌশল।
গত ২৪ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই চীন সফর করে ১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, কেন্দ্রীয় নেতা লুৎফুন নেসা খান বিউটি, তসলিমা খালেদ, জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আলম স্বপন, কুষ্টিয়া জেলা সহসভাপতি আহামেদ আলী প্রমুখ।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা