আপডেট : ৯ অক্টোবর, ২০২২ ০৮:০৩
উত্তরার বারে ডিবির অভিযানকে বেআইনি বলছে ডিএনসি

উত্তরার বারে ডিবির অভিযানকে বেআইনি বলছে ডিএনসি

ছবি: সংগৃহীত

নুরুজ্জামান লাবু ও শাহরিয়ার হাসান

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর উত্তরার গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউয়ের যে বারে গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল সেটি বৈধভাবেই চলছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) থেকে লাইসেন্স নিয়ে বারটি পরিচালনা করা হচ্ছিল। পুলিশ ওই বারের নাম কিংফিশার বললেও প্রকৃতপক্ষে সেটা ছিল লেকভিউ রেস্টুরেন্ট।

ডিএনসি বলছে, ওই বারে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। আর বার থেকে যেসব মদ-বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে, লাইসেন্স অনুযায়ী তারা সেসব সংরক্ষণ করতে পারে। এমনকি ডিবি পুলিশের অভিযানকেও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড মনে করছেন ডিএনসির কর্মকর্তারা।

তবে ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিএনসির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে উত্তরা এলাকার ওই বারে অবৈধভাবে মদ-বিয়ার রেখে ব্যবসা করা হচ্ছিল। অভিযানের সময় সংরক্ষিত মদ ও বিয়ার আমদানির বৈধ কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। এ জন্য বারের মালিক মুক্তার হোসেনসহ ম্যানেজার ও ওয়েটার মিলিয়ে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার উত্তরার একটি ভবনে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। সেখানকার একটি বার থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ক্যান বিয়ার ও সাড়ে চার শতাধিক বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করার কথা ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়। ডিবির দাবি, ওই ভবনে অবৈধভাবে দেশি-বিদেশি মদ ও বিয়ারের ব্যবসা করা হয়। কিংফিশার রেস্টুরেন্ট নামে ওই ভবনের পঞ্চম, ষষ্ট ও সপ্তম তলায় অবৈধ কার্যক্রম চলত।

অভিযানের পর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘রাজধানীর ১৩ নম্বর সেক্টরের গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ নামে একটি বাড়িতে শত শত ছেলেমেয়ে গান-বাজনার নামে ডিজে পার্টি এবং প্রচুর পরিমাণ মদ সেখানে বিক্রি হচ্ছে বলে আমাদের কাছে গোপন তথ্য আসে। এই তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ডিসি ডিবি উত্তরার সব টিম ওই বাড়িতে গিয়ে সেখানে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি মদ ও বিয়ার মজুত দেখতে পায়। ডিবি এসব বিদেশি মদ ও বিয়ার একত্র করে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায় এইগুলো তারা কীভাবে দেশে নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্যই ডিবিকে জানাতে পারেনি। এ কারণে মদ ও বিয়ার জব্দের পাশাপাশি তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।’

তবে কিংফিশার রেস্টুরেন্ট ও লেকভিউ বারের মালিক মুক্তার হোসেনের দাবি, ডিবি পুলিশ তাদের কোনো কথাই শুনতে চায়নি। অভিযানের সময় বারের লাইসেন্স ও মদ-বিয়ারের ইনভয়েস দেখাতে চাইলেও তা দেখেনি। তারা সব কর্মীকে একটি কক্ষে আটকে রেখে অভিযান চালিয়েছে। বারে থাকা মদ ও বিয়ারের সব ইনভয়েস তার কাছে আছে বলেও জানান তিনি।

মুক্তার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিয়ে বার চালাই। গুলশান এবং মিরপুরেও আমার লাইসেন্স করা বার আছে। প্রতি বছরই আমি নির্ধারিত ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করি। আমি তো আইনি অনুমোদন নিয়ে বৈধ ব্যবসা করছি। প্রতি মাসেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আমার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। তবু কেন হঠাৎ অভিযান চালিয়ে আমাকে “ভিলেন” বানানো হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। আর আমি যদি বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বৈধভাবে ব্যবসা করে লাভবান হই তাতে তো কারও আপত্তি থাকতে পারে না। আমি আগে ওয়েটার ছিলাম, এটা তো আমার অপরাধ হতে পারে না। মানুষ তো ছোট থেকেই বড় হয়। আমি এখন আইনগতভাবেই মোকাবেলা করব। আমার মনে হচ্ছে কারো ইন্ধনে ডিবি পুলিশ এই অভিযানটি চালিয়েছে।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উত্তরা এলাকার পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘লেকভিউ বারের লাইসেন্স সঠিক আছে। গত মাসেই আমি পরিদর্শন করেছি। তাদের কাগজপত্র ঠিক আছে। অভিযানের সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি সেখানে গেলে ডিবির সদস্যরা আমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে। আমাকে একটি কক্ষে আটকে রেখেছিল। আমার মোবাইল সিজ করে রাখে। আমি সরকারি গাড়ি নিয়ে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ডিবি পুলিশের দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়েছি।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দর পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ এর উপ-ধারা ২ এ অভিযান পরিচালনা করার বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে। এখানে আইনের কোনও ব্যতয় ঘটেনি। আমরা আইন অনুযায়ী অভিযান চালিয়েছি।

তিনি বলেন, আমরা রাত ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত বৈধ কাগজপত্র দেখানোর জন‌্য অপেক্ষা করেছি, কিন্তু তারা তা দেখাতে পারেনি। কাগজপত্র হেড অফিসে আছে বললেও তা হাজির করতে পারেনি। 

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স অনুযায়ী পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় বার থাকার কথা। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মদ ও বিয়ার পেয়েছি সপ্তম তলায়। সেখানে তো এসব থাকার কথা না

তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, উত্তরার লেকভিউ বারে অভিযানের সময় ডিএনসির মাহবুবুর রহমান ঘটনাস্থলে গেলে তাকে আটকে রাখে ডিবির সদস্যরা। মাহবুবের নিজের ও তার আইডি কার্ডের ছবি তুলে নিয়ে যায়। তবে অভিযান শেষে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া ওই ভবনের সিসি ক্যামেরার সব ফুটেজও নিয়ে যান ডিবির সদস্যরা।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারা বিষয়টি লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, একটি সরকারি সংস্থার লোকজন আরেকটি সরকারি সংস্থার সদস্যের সঙ্গে যে আচরণ করেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। পুলিশও যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। দুটি প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করবে এটাই হওয়া উচিত। তা না করে দুটি সংস্থার মধ্যে বিবাদ বা দূরত্ব তৈরির চেষ্টা চলছে।

সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন বার থেকে একচ্ছত্রভাবে মাসিক চাঁদা আদায় করে ডিএনসির কিছু কর্মকর্তা। সেখানে পুলিশ সদস্যরা তেমন গুরুত্ব পান না। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ডিবি অভিযান চালানো শুরু করেছে। লেকভিউ বারে গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। এ নিয়ে সম্প্রতি একটি ঝামেলা তৈরি হয়। সেই ঝামেলার ধারাবাহিকতায় অভিযান চালানো হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে গত শুক্রবার ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘সেখানে কাদের যাতায়াত ছিল সে বিষয়ে আমরা তদন্ত করব।’

বারের লাইসেন্স ও মদ-বিয়ারের ইনভয়েস থাকার পরও অভিযান করে মালামাল জব্দ এবং মামলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার আকরামুল হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সামনে তারা লাইসেন্স বা ইনভয়েস দেখাতে পারেনি বলেই আমরা মদ-বিয়ার জব্দ ও ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। যদি বার মালিক আদালতে বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেন তবে সে অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন।’

বারের অভিযানে নিয়মের ধার ধরে না কেউ

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ এর ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ পুলিশ, কাস্টমস, বিজিবি, কোস্টগার্ড লাইসেন্স করা প্রতিষ্ঠান ছাড়া যেকোনো মাদকের বিষয়ে অভিযান চালাতে পারে। তবে আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স নেয়া প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালাতে পারবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘অধিদপ্তরের ধারায় স্পষ্ট করে বলা রয়েছে, বৈধ বারে অভিযান করতে গেলে আমাদের জানাতে হবে। শুক্রবারের ঘটনায় পুরোপুরি আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। এখানে পুলিশকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আলাদা করে কিছু বলার নেই। যা বলার আদালেই বলবেন।’

এদিকে বিভিন্ন ক্লাব ও পানশালায় অভিযান চালিয়ে মদ বাজেয়াপ্ত করার অভিযোগ করেছেন বৈধ মদের বারের মালিকেরা। তারা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অহেতুক অভিযান চালিয়ে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন। আবার জব্দকরা বৈধ মদ ফিরে পেতেও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ব্যবসা চালিয়ে যেতে এই সমস্যাগুলোর সমাধান চেয়েছেন বৈধ মদ ব্যবসায়ীরা। গত আগস্টে  মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) প্রধান কার্যালয়ে এ বিষয়ে ব্যবসায়ী ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়।

বৈঠকে বার সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, ২০১৯ সালের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় থেকে মদের বারগুলোতে একের পর এক অভিযান চলেছে। তখন থেকেই বিভিন্ন সময় র‍্যাব, পুলিশ, ভ্যাট গোয়েন্দারা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রভাব আর এসব অভিযানের কারণে তাদের ব্যবসা বন্ধের পথে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্যমতে, সারা দেশে দেশি ও বিদেশি মদ বিক্রির ৫০৬টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ১৪৭ প্রতিষ্ঠানের আছে ১৮৯টি বার। দেশি মদ বিক্রি করছে ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান। দেশে মদের বারের লাইসেন্স দেয়া, মদ খাওয়ার অনুমতি দেয়া থেকে শুরু করে সব বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। বার মালিকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা ভ্যাট কর্মকর্তারাও অভিযান চালাবে না। 

রাজধানীর একটি বারের মালিক দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো বৈধভাবে ব্যবসা করি। যে থানা বা র‍্যাবের ব্যাটেলিয়নের এলাকায় ব্যবসা করি, তারা ছাড়াও অন্য ইউনিটের সদস্যরা এসেও অভিযান চালান। এই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, অভিযানের নামে যেসব মদের বোতল জব্দ করে নিয়ে যায় পরে সেগুলোর বিপরীতে বৈধ কাজপত্র দেখিয়েই আদালত থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।