ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার সাফল্য আর বিতর্ক সমান্তরালে চলেছে। যাকে ডাকা হতো ক্রিকেটের বরপুত্র নামে। তিনি আর কেউ নন, তিনি সোনালি চুলের স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্ন।
গত বছরের মার্চে মাত্র ৫২ বছর বয়সেই ইহজগতের মায়া কাটিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ওয়ার্ন। তবুও তাকে মনে রেখেছে ভক্তরা। ক্রিকেট মাঠে কিংবা জীবনের মঞ্চে তিনি ছিলেন রহস্যময়। এই স্পিন জাদুকরের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, অস্ট্রেলিয়ায়।
তার বোলিং ক্যারিশমায় ধরাশয়ী হতো বিপক্ষ দলের বাঘা বাঘা ব্যাটার। ওয়ার্নের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। তখন তিনি ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হন। লেগ স্পিন এবং অফ স্পিন, দুটোতেই তার সমান পারদর্শিতা ছিল। লোয়ার অর্ডারে ব্যাটসম্যান হিসেবেও দলে ভূমিকা রাখতেন। পরে তিনি সেন্ট কিল্ডা ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেন। ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ফুটবলও খেলতেন তিনি।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া শেন ওয়ার্ন নির্বাচকদের নজরে আসেন সেপ্টেম্বর মাসে। জিম্বাবুয়ে সফরে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া ‘বি’ দলে জায়গা করে নেন তিনি। চার দিনের ম্যাচে ৫২ রান দিয়ে ৭ উইকেট শিকার করে সবার নজর কাড়েন ওয়ার্ন।
জাতীয় দলের হয়ে তার অভিষেক হয় টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। ১৯৯২ সালের ২ জানুয়ারি ভারতের বিপক্ষে তিনি প্রথম টেস্ট খেলতে নামেন। ডান-হাতি লেগ স্পিন শৈলী তাকে বানিয়েছে ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বোলারদের একজন।
টেস্ট অভিষেকের এক বছর পর ১৯৯৩ সালের ২৪ মার্চ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় ওয়ার্নের। এর পরের কথা তো আর পাঠকদের অজানা নয়। নব্বই দশকের পুরোটাই নিজের করে নিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি।
তাকে মনে রাখার জন্য তার পুরো ক্যারিয়ার মনে রাখার দরকার নেই। ১৯৯৩-৯৪-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্লাসিক, বল অব দ্য সেঞ্চুরি, মেলবোর্নে হ্যাটট্রিক, বিশ্বকাপে ফাইনাল সেরা এবং পাকিস্তান বধ। আর বিশেষভাবে বলতে গেলে ২০০৫ সালের অ্যাশেজ। এই অ্যাশেজ সিরিজ দিয়েই তাকে কিংবদন্তি আসনে বসিয়ে দেয়া যায়। পাঁচ ম্যাচে ১৯ দশমিক ৯২ গড়ে শিকার করেছিলেন ৪০ উইকেট।
এই কিংবদন্তি ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেন। ১৫ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ১৪৫টি টেস্ট খেলে শিকার করেন ৭০৮টি উইকেট। আর ১৯৪টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে তুলে নেন ২৯৩টি উইকেট। ব্যাট হাতেও দুর্দান্ত ছিলেন তিনি। টেস্টে ৩১৫৪ রানের পাশাপাশি ওয়ানডেতে করেছেন ১০১৮ রান।
১৯৯৯-এর বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালের নায়ক ছিলেন ওয়ার্ন। অজিদের হয়ে বিশ্বকাপ জয়, উইজডেনের বর্ষসেরা খেলোয়াড় তিনি। অধিনায়ক হিসেবে আইপিএলের প্রথম আসরে রাজস্থান রয়্যালসকে ট্রফি জিতিয়েছিলেন তিনি। অর্জনের খাতাটা নেহাত কম ভারী নয়। জিতেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা পুরুষ ক্রিকেটারের পুরস্কার। তার মৃত্যুর পর এই পুরস্কারের নাম বদলে রাখা হয় শেন ওয়ার্ন অ্যাওয়ার্ড নামে।
পেশাদার ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি রেকর্ডের মালিকও ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে সর্ব কালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনি।। অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে সর্বাধিকবার এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট সংগ্রহকারীও তিনি। মোট ৩৭ বার টেস্টে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন শেন ওয়ার্ন। লেগ স্পিনার হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেটে সর্বাধিক উইকেট শিকারি শেন ওয়ার্ন। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ৭০০ উইকেট নেয়ার কীর্তিও তার দখলে।
ক্রিকেট মাঠের বাইরেও ওয়ার্নের জীবনে আরেকটা অধ্যায় ছিল। বিচিত্র ঘটনার জন্ম দিয়ে প্রায় সময় আলোচনায় থাকতেন তিনি। মাদক নেয়া, কথা দিয়ে কথা না রাখা, নারী কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাও ছিল তার বিতর্কের ঝুলিতে। সতীর্থ স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েও একাধিকবার আলোচনায় এসেছেন। ২০০৩ বিশ্বকাপের শুরুর এক দিন আগে ড্রাগস টেস্টে ফেল করে দল থেকে বাদ পড়ার ঘটনাও রয়েছে তার ক্যারিয়ারে।
ওয়ার্ন যখন ক্রিকেটে এসেছিলেন, তখন ক্রিকেট জগতে রাজত্ব করছে বাঘা বাঘা পেসারদের গতি আর বাউন্স। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেগ স্পিনকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করেছেন তিনি। মাঠের ক্রিকেট, লেগ স্পিন কিংবা জীবনের মায়া ছাড়লেও ওয়ার্ন বেঁচে আছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের অন্তরে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা