সোনালি আঁশের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু পাটের সুদিন এখন আর নেই। গেল কয়েক বছর থেকেই পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওযায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন নওগাঁর চাষিরা। চলতি বছরে অনাবৃষ্টির কারণে পাটের ফলন যেমন কম হয়েছে, তেমন বেড়েছে খরচও। এ ছাড়া শুরুতেই পাট জাগ দেয়া নিয়েও কিছুটা বিপাকে পড়তে হয় তাদের। তবে বর্তমান বাজারে পাটের যে দাম সেই দাম নিয়ে শঙ্কার মধ্যে দিন পার করছেন চাষিরা। চাষের খরচ তোলা নিয়েও চিন্তায় রয়েছেন তারা। দাম কমে যাওয়ার জন্য চাষিরা সিন্ডিকেটকে দুষছেন।
তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের কাছে এখনো গত বছরের পাট রয়েছে। মিল-মালিকদের কাছে পাট বিক্রি করলে ঠিকমতো দেয়া হয় না টাকা। এ জন্য তারা পাট ক্রয় করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম।
কমেছে পাট চাষ
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় চলতি বছরে ৫ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে আবাদ হয়েছে ৪ হাজার ৫২০ হেক্টর। আর গত ৫ বছরে জেলায় পাটের আবাদ কমেছে ১ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে।
বিড়ম্বনার শিকার চাষিরা
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাট চাষের সময় এবার নানা বিড়ম্বনার শিকার হন চাষিরা। প্রথমত, বীজ বপনের সময় খরা হওযায় ঠিকমতো চারা গজায়নি। আবার চারা গজালেও পাতলা হয়েছে। এতে করে ব্যাহত হয়েছে পাটের ফলন। এ ছাড়া শ্রমিকের বাড়তি মজুরি, সেচ, বীজ, কীটনাশক, সারের দাম বৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন খরচও। অন্যদিকে পাট কাটার সময় পানির অভাবে অনেক কৃষককে ভোগান্তি পোহাতে হয়। সঠিক সময় পাট জাগ দিতে না পারায় নষ্ট হয়েছে পাটের কালার।
খরচ তুলতে হিমশিম
চাষিরা বলছেন, এক বিঘা জমিতে হালচাষ থেকে শুরু করে বীজ, সার, কীটনাশক, পানি সেচ, নিড়ানি, কাটা, জাগ দেয়া ও শ্রমিকসহ ঘরে তোলা পর্যন্ত খরচ পড়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ফলন হচ্ছে ৭ থেকে ১০ মণ। শুরুতে পাটের দাম ২ হাজার ৬০০ টাক মণ থাকলেও বর্তমানে বাজরে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছর এই সময় প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার সতিহাট গিয়ে দেখা যায়, এই হাটে ভোর থেকেই প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত পাট ভ্যানগাড়ি-সাইকেলে করে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন। এরপর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চলছে দর-কষাকষি। গড়ে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। তবে বাজারে যে দামে পাট বেচাকেনা হচ্ছে তাতে কোনো কোনো চাষিকে পাট বিক্রি করে বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে।
সিন্ডিকেটে আটকা দাম
পাট বিক্রি করতে আসা উপজেলার গণেশপুর গ্রামের চাষি আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। খরার কারণে সেচ দিয়ে পাট চাষ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এবার পাট চাষে অনেক খরচ হয়েছে। কিন্তু সেই হিসাবে বাজারে পাটের দাম পাচ্ছি না। এক বিঘা জমি থেকে ৮ মণ পাট পেয়েছি। আজকে ২ হাজার ১০০ টাকা মণ হিসাবে বিক্রি করলাম। আপনারাই বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে কত টাকা লাভ হয়েছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে পাট বিক্রি করে ইলিশ মাছ কিনতাম। এখন সেই ইলিশ মাছও হারিয়ে গেছে, পাটের দামও হারিয়ে গেছে। বাজারে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পাট কম দামে কিনে। আমরা যে রোদে পোড়ে জমিতে চাষ করি এর কোনো মূল্য নেই। সরকার এদিকে নজর না দিলে সামনের বছর থেকে মানুষ পাট চাষ করা ছেড়ে দেবে।’
একই উপজেলার চকরাজাপুর গ্রামের পাটচাষি আব্দুস সালাম বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ৭ মণ পেয়েছি। খরার কারণে প্রথমেই পাটের গাছ মরে গেছে। সেচ দিয়ে কোনো রকম রক্ষা করা হয়েছে। এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। পাট পেয়েছি ৭ মণ। বিক্রি করতে গিয়ে পাচ্ছি ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা। এতে করে আমাদের কয় (কত) টাকা লাভ হবে বলেন।’
নওগাঁ সদর থেকে পাট বিক্রি করতে গেছেন জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় ৭ মণ করে পেয়েছি। অনাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হয়েছে। এ ছাড়া পানির অভাবে সঠিক সময় পাট জাগ দিতে না পারায় কালার নষ্ট হয়ে গেছে। একে তো কালার নষ্ট হয়ে গেছে এর মধ্যে আবার বাজারে পাটের দাম খুবই কম। ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট করে কম দামে পাট কেনে। আমরা কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাই না।’
অখিল কুমার নামে এক পাট ব্যবসায়ী বলেন, ‘২৫ থেকে ৩০ বছর থেকে পাটের ব্যবসা করি। এখান থেকে পাট কিনে খুলনা-যশোরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকি। মোকামে বেচাকেনা না থাকায় পাটের দাম কমে গেছে। আগামীতে দাম বাড়বে কি না, বলা যাচ্ছে না।’
ব্যবসায়ীরাও চান বাজার তদারকি
শফিক আলী ও আবু বক্কর নামের দুই ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত বছরের ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ হিসাবে অনেক পাট কেনা আছে। সেই পাটই বিক্রি করতে পারি নাই। মিলারদের পাট দিলে তারা টাকা দিতে চায় না। আমাদের মতো ব্যসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরাও চাই সরকার বাজার তদারকি করুক।’
রফিকুল আলম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত বছরের পাটই এখনো বিক্রি করতে পারিনি। পাট কেনার পর থেকেই পাটের দাম কমে গেছে। এ বছর টাকা না থাকায় পাট কিনতে পারছি না। বাজারে এসে শুধু ঘোরাফেরা করি। এমনিতেই দুই তিন বছরের পাট কিনে লসে রয়েছে।’
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পাটের বীজ বপনের সময় বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে কৃষকরা সঠিক সময়ে জমিতে পাটের বীজ বপন করতে পারেনি। এ ছাড়া পাট কাটার সময় পানির অভাবে জাগ দেয়ার যে সমস্যা, সেই কারণে কৃষকরা পাট চাষ করতে চায় না। এসব কারণে পাটের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে চাষ হয়েছে। তবে পাটের ফলনে কোনো বিপর্যয় ঘটেনি।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা