আপডেট : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১১:০২
অপ্রতিরোধ্য পাহাড়খেকোদের দৌরাত্ম্য থামবে কবে?
এম এ মান্নান

অপ্রতিরোধ্য পাহাড়খেকোদের দৌরাত্ম্য থামবে কবে?

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘বন্যেরা বন্যে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। সহজ কথায় বলা যায়, যারা বনবাসী তাদের বনেই মানায়, বনেই শোভা পায়। যেমন মায়ের কোলে শোভা পায় বা মানায় শিশুকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। দূরের পাহাড় যেন সত্যিই আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। যে পাহাড় আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমায়, সেই পাহাড়ের ঘুম ভাঙানো কি ঠিক হবে? ঘুম ভাঙালে সে তো রুষ্ট হবেই।

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাসযোগ্য পৃথিবীকে অবাসযোগ্য করে তুলেছি আমরাই। আমরাই প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে আঘাত করে চলেছি, ধ্বংস করে চলেছি। আর প্রকৃতিও মাঝেমধ্যে আমাদের পাল্টা আঘাত করছে। আর আমরা তাই গৎবাঁধা একটা কথা বলে থাকি ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়’। কিন্তু এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য যে আমরা মানুষেরাই দায়ী তা কেউ স্বীকার করছি না। আবার স্বীকার করলেও আমলে নিচ্ছি না। তাই প্রকৃতিও আমাদের ক্ষমা করছে না।

২০০৭ সালে চট্টগ্রামের ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কেটে পাহাড়ের প্রতি অবিচার করেছি। এখনো করে যাচ্ছি। শুধু অবিচার করিনি, পাহাড়ের অস্তিত্বে আঘাত করে চলেছি। তাই পাহাড় আমাদের প্রতি ক্ষীপ্ত হয়ে পাল্টা আঘাত করেছে। এক দিনেই কেড়ে নিয়েছে ১২৭ জনের প্রাণ। দেশজুড়ে ছিল শোকের ছায়া। এতগুলো প্রাণ এক দিনে মাটিচাপায় মারা গেলে শোক-তাপ-কান্না তো ঠেকানো যায় না। যেমন ঠেকানো যায়নি পাহাড় কেটে যারা বসতি স্থাপন করেছিলেন তাদের।

বাংলাদেশে যত বন বা পাহাড় আছে, তা দখল বা ধ্বংস করার জন্য মানুষ উঠেপড়ে লেগেছে বহু আগে থেকেই। তাই দেশে ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে বন ও পাহাড়। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, ২০০৭ সালে পাহাড়ধসের ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর ১৮ জন সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের কাজ ছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনার। অর্থাৎ পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণ করা। কিন্তু পাহাড় কাটা, পাহাড় দখল এবং পাহাড়ে বসতি স্থাপনের হিড়িক দেখে তো মনে হয় যে তারা পাহাড় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। বরং রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যদি তাই না হতেন, তাহলে এখনো পাহাড়ধসের মতো ঘটনা ঘটে কেন? এখনো পাহাড়ধসে মাটিচাপায় মানুষ মরে কেন।

খোর, খেকো- এজাতীয় শব্দের সঙ্গে আমরা প্রায়ই পরিচিত হই। খোর আর খেকোর আবিধানিক অর্থ প্রায় একই- খাদক, ভক্ষণকারী, আসক্ত। এরই একটা নিষ্কৃষ্ট মানের প্রজাতি হলো ভূমিখোর বা ভূমিখেকো। অথবা বনখোর বা পাহাড়খোকো। এই ‘খোর’ আর ‘খেকোর’ খপ্পরে পড়ে আমাদের দেশ থেকে উজাড় হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বন-পাহাড়। আর এভাবেই প্রকৃতি হারাতে বসেছে তার ভারসাম্য। আর আমরা আক্রান্ত হচ্ছি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর বন্যায়। নয়তো পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়ে মারা যাচ্ছি। প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম চট্টগ্রাম জেলায় এখনো ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। আর সেসব পাহাড়ে শত শত লোক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, পাহাড় রক্ষকের দায়িত্বে কেউ না থাকলেও ভক্ষণের দায়িত্বের লোকের অভাব নেই। যদি থাকত, তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে শত শত মানুষ বসবাস করেন কেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।’ তাহলে সরকারি পাহাড় কাটার মহোৎসব ঘটে কী করে। গত সোমবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখলাম গত রোববার আবারও চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে এবং সেই ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এবার পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। যারা এখন পাহাড়ে বসবাস করছেন, তাদের উচ্ছেদ করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। জানা যায়, ২৬টি পাহাড়ে নতুন করে লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছেন। এবারও হয়তো পাহাড়ধসের ঘটনায় নানা উদ্যোগ নেয়া হবে। কিন্তু ওই পর্যন্তই আর কোনো উন্নতি-অগ্রগতি হবে না।

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে- এ কথা আমরা শুনি। ইদানীং আমাদের বুদ্ধি এত বেশি পরিমাণে লোপ পেয়েছে যে চোর ঘর থেকে সব চুরি করে নিয়ে পালালেও এবং আমরা সজাগ হলেও বুদ্ধিতে কিছু আসে না। তাই ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও এবং মানুষ পাহাড়ে মাটিচাপা পড়লেও তাতে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান ছাড়া আর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

আমরা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি বা টেলিভিশনে দেখে থাকি সুন্দরবনের বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে। তাতে সুন্দরবন নিকটস্থ এলাকার সাধারণ মানুষের জীবন অনিরাপদ হয়ে যায়। তাদের রাত কাটে চরম নিরাপত্তাহীনতায়, আতঙ্কে-উৎকণ্ঠায় কখন যেন রাতের আঁধারে বাঘ এসে আক্রমণ করে তাদের ডেরায়। আবার কখনো শুনতে পাই বা দেখতে পাই, বন্য হাতি লোকালয়ে ঢুকে মানুষের খেতে-খামারে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। মানুষ হাতির দলকে তাড়াতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন এবং হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন।

সহজ কথাটা সহজ করে বুঝতে আমরা চেষ্টা করি না। বন্যেরা বন্যে সুন্দর কথাটাকে আমলে নিলেই এসব ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। বন ও পাহাড় প্রকৃতিগতভাবেই বন্য প্রাণীর জন্য অভরাশ্রম। তারা প্রকৃতিগতভাবেই বন-জঙ্গলে জন্মে, বন-জঙ্গলেই খাদ্য খায়, বন-জঙ্গলেই তারা বাস করে। প্রকৃতিগতভাবেই বন-জঙ্গলের মালিক তারা। মানুষ যেমন বন-জঙ্গলে নিরাপদ নয়, তেমনি পাহাড়-বন উজাড় করলে বন্য প্রাণীর জন্য নিরাপদ নয়। তাই নির্ভয়ে-নিরাপদে বসবাস করার জন্য বন্য প্রাণীকে তার পাহাড়-অরণ্য ফিরিয়ে দিতে হবে। এটা অধিকার। কিন্তু তাদের বাসস্থানে যদি আঘাত করা হয়, পাহাড় ও বন কেটে যদি উজাড় করা হয়, তাহলে তারা যাবে কোথায়? খাবে কী?

পৃথিবীতে যত পাহাড়-পর্বত-সুমুদ্র আছে তার কোনোটিই মানুষের সৃষ্টি নয়। প্রকৃতির দান। বরং মানুষ বেঁচে আছে বা সুবিধা ভোগ করছে সেই প্রকৃতির দান থেকেই। কিন্তু বাস্তব সত্য মানুষই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। প্রকৃতিকে অনিরাপদ করে তুলছে। আমরা নদীর দিকে তাকালে দেখি নদীদূষণ। বনের দিকে তাকালে দেখি বন উজাড়। পাহাড়ের দিকে তাকালে দেখি পাহাড় কর্তন। এসবের অনিষ্টকারী ওই একটি দল আদমসন্তান। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব।

নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। আর আমরা এত বড় পাগল যে নিজের ভালোটাও বুঝতে চেষ্টা করি না। আমরা সবাই জানি, ভারী বর্ষণের সময় পাহাড়ে বসবাস করা নিরাপদ নয়। যারা পাহাড়ে বসবাস করছেন তারা আরও ভালো জানেন। তারপর তারা কেন পাহাড়ে বসবাস করছেন। পাহাড়ধসে সবচেয়ে বড় অঘটনের মালিক পাহাড়খেকোরা। যারা পাহাড় কাটছেন, বন উজাড় করছেন। সবার আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে পাহাড়ধস বন্ধ হবে না। আমাদের দেশে একটা বাজে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে যে আগে অঘটন ঘটবে তারপর তা নিয়ে নড়েচড়ে বসবে প্রশাসন। সেটা করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এখন ভারী বর্ষণের সময়, এখনই পাহাড়কে নিরাপদ করতে পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন, তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে হবে। পাহাড় যেভাবে আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমায়, তাকে সেভাবে থাকতে দিতে হবে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক