আপডেট : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০৮:১৬
বৈশ্বিক মন্দায় দুর্বল চিংড়িশিল্প
আওয়াল শেখ, খুলনা

বৈশ্বিক মন্দায় দুর্বল চিংড়িশিল্প

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত এসেছে খুলনাঞ্চলের চিংড়িশিল্পে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা থেকে উৎপাদিত এসব চিংড়ি রপ্তানি হয় বিশ্বের ৫২টি দেশে।

মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে খুলনা থেকে ১৯ হাজার ৯০৪ দশমিক ৮৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ২ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ২৪ হাজার ১০৪ দশমিক ১২ মেট্রিক টন রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ২ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে ৪ হাজার ১৯৯ দশমিক ১৭৫ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি কমার বিপরীতে আয়ও কমেছে ১৯৯ কোটি টাকা।

মৎস্য পরিদর্শক ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার জন্য চিংড়ির রপ্তানি কমেছিল। পরের অর্থবছরে বেশ রপ্তানি হয়েছিল। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানি কমে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওই দুটি দেশে মাছের চাহিদা এবং মূল্য কমে গেছে। আগে প্রতিবছর রাশিয়ায় প্রায় ৬০ কোটি ও ইউক্রেনে ১১ কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানি হতো। যুদ্ধ শুরুর পর এসব দেশে রপ্তানি ৩ ভাগের ২ ভাগ কমেছে।

ইউরোপের বাজারে কড়াকড়ি

দেশ থেকে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের প্রায় ৮০ ভাগই রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। তবে ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বাজার থেকে ৭ কনটেইনার চিংড়িতে জীবাণু পেয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। পরবর্তী সময়ে সেগুলো পুনরায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। তাতে স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া, সিরিঞ্জের ভাঙা নিডল, মেলাকাইট গ্রিন অ্যান্টিবায়োটিক, ভিভরিওপ্যারা ভাইরাস ও সিমি কার্বাজাইড অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্ত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘মাছ ফেরত আসা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। নানা কারণে ফেরত আসতে পারে। রপ্তানির সময়ে চিংড়ি সব সময় নিম্ন তাপমাত্রায় রাখতে হয়। কোনো কারণে তাপমাত্রা ফেল করলে সেখানে ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে পারে। শুধু আমাদের দেশের নয়, ইউরোপ থেকে বিভিন্ন দেশের মাছ ফেরত যায়। ওই দেশের মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ স্থানীয় মার্কেট থেকে স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করে এসব জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে। ফলে এ জীবাণু যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে তা বলা যায় না।’

তবে ইউরোপের বাজারে চিংড়ি প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘তাদের চাহিদা মতো আমরা ১০ ধরনের পরীক্ষা করে তারপর চিংড়ি রপ্তানির ছাড়পত্র দিই। তাই আমাদের দেশের চিংড়ির বেশ সুনাম রয়েছে।’

ইতোপূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিশারিজ অ্যান্ড ভেটেনারিজ অর্গানাইজেশন (ইভিএফভিও) ২০০৯, ২০১১, ২০১৮ সালে খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার খামার এবং প্রক্রিয়াকরণ কারখানা পরিদর্শন করেছে। চলতি বছরের অক্টোবরে তারা আবারও বাংলাদেশে আসছে চিংড়ির উৎপাদন পরিদর্শনে।

এ প্রসঙ্গে লিপটন সরদার বলেন, ‘আমাদের দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিদর্শন ধারাবাহিক ঘটনা। এবার এসে তারা নতুন কোনো শর্ত দিলে তাও পূরণ করা হবে।’

রপ্তানিকারকদের সিন্ডিকেট

প্রায় ২০ বছর ধরে খুলনার পাইকগাছায় চিংড়ি চাষ করছেন সাইফুল্লাহ ইসলাম। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে চিংড়ির দাম প্রায় একই রয়েছে। বিশ্ব বাজারে দাম বাড়লেও যারা রপ্তানিকারক তারা দাম বাড়ান না। বর্তমানে চিংড়ির খাবার ও পোনার দাম বেড়েছে। তবে বিক্রি মূল্য বাড়ছে না। মূলত, রপ্তানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।

খুলনাঞ্চলে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ করে বিদেশে রপ্তানির জন্য মোট ৫৪টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরে লাইসেন্স নবায়ন করেছে ৪১টি। বর্তমানে চালু রয়েছে ৩০টি কারখানা।

আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে চিংড়ির দাম কম রয়েছে বলে দাবি করেছেন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্রাইট ও মডার্ন সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রেজাউল হক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও মূল্য কমে যাওয়ায় রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে। বিদেশের ক্রেতারা মূল্য পরিশোধেও দেরি করছেন।

রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু আহাদ হাফিজ বলেন, ‘বর্তমানে প্রক্রিয়াকরণ কারখানাতে আমরা চিংড়ি কম বিক্রি করছি। এর কারণ হচ্ছে কারখানাগুলো দীর্ঘদিন ধরে টাকা আটকে রাখছে। অন্য কারণ হলো কারখানা থেকে খোলা বাজারে বেশি দামে চিংড়ি বিক্রি করা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, দেশের বাজারে এখন সব মাছের দাম বেশি। খোলা বাজারে যেখানে এক কেজি চিংড়ি ৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে, কারখানাতে নিয়ে গেলে তার দাম বলছে ৬০০ টাকা। এ ছাড়া খোলা বাজারে অন্য মাছের দাম বাড়ায় চিংড়ির চাহিদা বেড়েছে। তাই বাজারগুলোতে বেশি মাছ চলে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘ইউরোপের বাজারে যারা চিংড়ি কেনেন, বাংলাদেশে তাদের বায়াররা রয়েছেন। তারা চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার সঙ্গে দরাদরি করে মাছ কেনেন। উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার কারণে আমরা দাম নির্ধারণ করে দিতে পারি না।’