আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৫:৩৪
এডিসি হারুনকাণ্ড: বারডেমে কী ঘটেছিল, জানালেন সিকিউরিটি সুপারভাইজার
মনিরুল ইসলাম, প্রতিনিধি, ঢাবি

এডিসি হারুনকাণ্ড: বারডেমে কী ঘটেছিল, জানালেন সিকিউরিটি সুপারভাইজার

গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের (বারডেম) চতুর্থ তলায় বরখাস্ত হওয়া রমনা অঞ্চলের এডিসি হারুন অর রশিদ ও রাষ্ট্রপতির একান্ত সহকারী সচিব আজিজুল হক মামুনের মধ্যে কী ঘটেছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন ওই সময় হাসপাতালে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি সুপারভাইজার ওয়ারেছ আলী।

গতকাল বুধবার বিকেলে ওয়ারেছ আলী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিন জড়িত কাউকে আমি চিনতাম না। পরে টিভি ও পত্রিকায় খবর পড়ে তাদের পরিচয় জানতে পারি। সেদিন আমি রাউন্ড ডিউটিতে ছিলাম আর আমার কিছু সিকিউরিটি কর্মী নিচে ছিল। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড় শুনে যখন চতুর্থ তলায় আসি, তখন দেখি, হারুন সাহেব (বরখাস্ত হওয়া রমনা অঞ্চলের এডিসি হারুন অর রশিদ) ইটিটি রুমের সামনে, যেখানে মানুষ ওয়েটিংয়ে থাকে, সেখান থেকে লবি হয়ে লিফটের দিকে দৌড়াচ্ছেন। আর তার পেছন পেছন ছুটছিলেন মামুন সাহেব (রাষ্ট্রপতির একান্ত সহকারী সচিব আজিজুল হক)। তবে সেসময় লিফট বন্ধ থাকায় এবং নিচ থেকে আরও দুইজন চলে আসায় হারুন সাহেব ফের ইটিটি রুমের দিকে দৌড় দেন। এ সময় মামুন সাহেব এবং নতুন আসা বাকি দুইজনও হারুন সাহেবের পেছু নেয়।’

তিনি বলেন, ‘এরপর দুই পক্ষই ইটিটি রুমের সামনে গেলে আশেপাশের মানুষও জড়ো হয়ে যায়। আমরা যারা নিরাপত্তাকর্মী আছি, তারাও দৌড়ে যাই। তখন দেখি এই তিনজন হারুন সাহেবকে মারতে চাচ্ছিল আর ওনাকে টেনে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিল। আর হারুন সাহেব চাচ্ছিল ইটিটি রুমের ভেতর ঢুকতে। এরপর আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলি, এখানে কোনো গ্যাঞ্জাম হবে না। আপনারা আপনাদের পরিচয় দেন। তখন তিনজনের দলটি আমাদের বলে, তোরা সিকিউরিটি অফিসার। তোদের সঙ্গে কোনো কথা নেই। তোরা এখান থেকে সর।’

ওয়ারেছ আলী আরও বলেন, ‘এর মাঝখানে কেউ একজন হারুন সাহেবের মোবাইল ফোন কেড়ে নিলে আমরা তাদের থেকে মোবাইলটা নিয়ে ওনাকে ফেরত দিয়ে দেই। তখনো তারা সেই পুলিশ অফিসারকে মারতে চাচ্ছিল। কিন্তু আমরা মাঝখানে থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। যা লেগেছে, সব আমাদের গায়ে লেগেছে। তবে শুনেছি, আমরা আসার আগে মারামারি হয়েছে। কিন্তু সেটা আমরা দেখিনি। এ সময় দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কিতে ইটিটি রুমের দরজা খুলে যায়। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিল সানজিদা ম্যাডাম (ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন)। ওনার নামটাও আমরা পরে রিপোর্ট আর টিভিতে দেখে জানতে পেরেছি।’

‘এরপর পুলিশ অফিসার (হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের ভেতর ঢুকে রুমের এক কোণায় অবস্থান নেয়। তখন ওনাকে দেখে মনে হয়েছে, উনি খুব আতঙ্কে আছেন। এদিকে হারুন সাহেব ঢুকার পর পর বাকি সবাইও রুমের ভেতর ঢুকে যায়। তখনো আমরা দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর মামুন সাহেব তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বলছে, ছবি তোল, ভিডিও কর। এ সময় আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, তিনি এটার প্রতিবাদ করে তাদের রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তখন মামুন সাহেবকে তার গায়ে হাত দিতে দেখি,’ যোগ করেন তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে ৯৯৯ এ ফোন করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যখন অবস্থা, তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের প্রশাসনকে জানাই। এরপর আমরা ৯৯৯ এ ফোন দেই। আমি যখন বের হচ্ছি, তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে ধরতে চেষ্টা করছিলেন কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা কর্মীরা মাঝখানে দাঁড়ানো থাকাই সেটি করতে পারছিলেন না। এ সময় সেখানে একজন ড্রাইভার ছিল। উনিও নিরাপত্তাকর্মীদের সহযোগিতা করে তাদের নিভৃত করার চেষ্টা করছিল।’

ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘যেহেতু আমি প্রধান নিরাপত্তাকর্মী, তাই ঘটনার সময় আমার এদিক-সেদিক দৌড়ানো লাগছে। তাই সব ঘটনা আমি দেখিনি।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ নামের আরেক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, ‘ইটিটি রুমের সামনে হাতাহাতি হয়েছিল। তবে কে কার গায়ে হাত তুলেছে, সেটা মনে পড়ছে না। ইটিটি রুম খুলে যাওয়ার পর সবাই যখন, ভেতরে ঢুকে যায়, তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে (হারুন অর রশীদ) বের হতে বলে।’

‘যেহেতু বের করতে পারলে কিছু হয়ে যেতে পারে, সেজন্য তাদের আমরা বলি, আপনারা আগে বের হন। এরপর আমরা ওনাকে বের করছি। কিন্তু তারা আমাদের কথা না শোনায় আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের নিভৃত করার চেষ্টা করি।’

রশিদ আরও বলেন, ‘সবাই যখন ইটিটি রুমের ভেতরে, তখন আমাদের যিনি রোগী ছিলেন ওনাকে মামুন সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুনি, ‘আপনি এখানে কেন? আর ওনাকে কেন মারতে চাচ্ছেন? ডাক্তার দেখাতে আমিই স্যারকে নিয়ে আসছি। আপনি চলে যান। এরপর মামুন সাহেব বলেন- তুই আসলি কী জন্য? আর ও কেন আসলো? এরপর আমাদের রোগী সানজিদা ম্যাডাম বলেন- ‘আমি অসুস্থ আপনি তো জানেন। আপনি কেন আনেননি আমাকে? তাই আমি স্যারকে নিয়ে আসছি।’

রশিদ আরও বলেন, ‘এ ছাড়া আরও অনেক কথাবার্তা হচ্ছিল। সব আমাদের ঠিক মনে নেই।’

এই নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পর মূলত পুলিশ আসে। হারুন সাহেব যাকে যাকে দেখিয়েছেন, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তবে হাসপাতালের ভেতর পুলিশ কাউকে মারধর করেনি।’

ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘ঘটনার শেষে রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ইটিটি রুমের ভেতরে একটা ভাঙা চশমা পাওয়া যায়। এরপর সেটা আমরা পুলিশে হস্তান্তর করি। তারা সেটা নিয়ে যায়।’

এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে চার তলায় থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সেদিন আমি চারতলার সিঁড়িতে বসে ছিলাম। তখন দেখি লিফটের সামনে থেকে হারুনকে ((বরখাস্ত হওয়া রমনা অঞ্চলের এডিসি হারুন অর রশিদ) কেউ একজন টেনে কলার ধরে ইটিটি রুমের দিকে নিয়ে গেল। দৌড়ে আমিও সেখানে যাই। এরপর দেখি সেই লোক ওনার কয়েকটা ছবি তুলল। এ সময় হারুন মাস্ক পড়লে সে বলে, মাস্ক পড়েন কেন? মাস্ক খুলেন। তখন হারুন মাস্ক খুলে বলেন, তুলেন, তুলেন, সমস্যা নেই। এরপর এই লোক কাকে যেন ফোনে বলে, তাড়াতাড়ি আসো। এরপর আরও তিনজনকে আসতে দেখি। পরে একজন হারুনকে একটা ঘুষি মারে। এ সময় নতুন আসারাও ওনাকে কয়েকটা মারছে। এরপর সবাই রুমের ভেতরে ঢুকে যায়।’

এই কর্মচারী বলেন, ‘অনেকক্ষণ পর যখন পুলিশ এসে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন হারুন সাহেবের একটু পাওয়ার আসলো। তখন উনি তাদের ওপর হাত তুলতে চেয়েছে। কিন্তু হাত তুলতে পারেনি। দৌড়ে তাদের গায়ে ধাক্কা দিছে।’

সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি তখন সেখানে ছিলাম না। তবে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আমাদের চারতলায় যেখানে ইটিটি করানো হয় সেখানে হৈ-চৈ এবং হট্টগোল শুনে নিরাপত্তাকর্মীরা দৌড়ে যায়। যাওয়ার পরে তারা দেখে তাদের মধ্যে হাতাহাতি কিংবা বাক-বিতণ্ডা চলছে। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা দুই পক্ষকে আলাদা করার চেষ্টা করেছে। এ সময় আমাদের সিকিউরিটি সুপারভাইজার ওয়ারেছ আলী আমরা যারা প্রশাসনে আছি, তাদের ঘটনা জানিয়ে ৯৯৯ ফোন দেয়। এরপর আমরাও পুলিশকে জানাই। আমাদের ফোন দেয়ার কারণে হোক বা অন্য কারণে হোক হাসপাতালে পুলিশ আসে। এরপর পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’