জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারধরে সভাপতি তামান্না জেসমিন রীভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার সমর্থকরা একপক্ষ, অন্যপক্ষে আছেন ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় সেদিন রাতেই ইডেন কলেজ কমিটি স্থগিত করা হয় এবং গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়ার কারণে সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস ও তার সমর্থক ১২ নেত্রীসহ ১৬ নেতা-কর্মীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সহসভাপতির পক্ষ থেকে সভাপতি রীভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন, হলের সিট-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে। সবচেয়ে লজ্জা, অপমানের অভিযোগ হচ্ছে, ছাত্রীদের ওপর জোর খাটিয়ে অনৈতিক কাজ করানো। ইডেন কলেজে সিট-বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ নতুন কিছু নয়, আগেও শোনা গেছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লোভ আর ভয়ের রাজত্ব চলছে। শ্রমবিহীন টাকার সহজ আগমন থাকলে ছাত্ররাজনীতিতে নৈরাজ্য তৈরি হবেই।
সভাপতি তামান্না যে সিট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তা ফাঁস হওয়া একটি অডিও রেকর্ড থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। অডিও রেকর্ডে তিনি যেভাবে হলের ছাত্রীদের হুমকি দিচ্ছিলেন, তা রীতিমতো আতঙ্কের। তার হুমকির মধ্যে উল্লেখ ছিল, হল কর্তৃপক্ষ নয়- তিনিই সিট বরাদ্দ দেয়ার একমাত্র ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তার কথায় মনে হলো, ছাত্রীনিবাসে ‘পলিটিক্যাল রুম’ রয়েছে এবং পলিটিক্যাল রুমগুলো তার সিদ্ধান্তে বরাদ্দ হয়। সভাপতির সিট-বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজি নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলায় এক ছাত্রীকে অপদস্থ করার কাহিনিও একটি ভিডিওতে প্রচারিত হচ্ছে। ছাত্রীদের তরফ থেকে সিট-বরাদ্দ দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কলেজ কর্তৃপক্ষ অবুঝ শিশুর মতো অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। যেহেতু তারা কোনো ছাত্রীর কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পায়নি, তাই এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কত সহজ-সরল উক্তি! এমন অকর্মণ্য রোবট ব্যক্তিদের ভিসি, প্রাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ, প্রভোস্ট, হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করে দেয়া হচ্ছে। যে হলে টর্চারসেল থাকে, উলঙ্গ দেহের ছবি তুলে নেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়, সেই হলের পলিটিক্যাল নেতার বিরুদ্ধে নালিশ করার সাহস করবে কে? লজ্জা শুধু অধ্যক্ষ, প্রভোস্ট আর হাউস টিউটরের নয়, এ লজ্জা আমাদের সবার।
ইডেন কলেজের সভাপতি প্রচলিত নিয়মে কোনো অন্যায় করেনি। এর অর্থ এই নয় যে, আমি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের লাখ লাখ টাকার বাণিজ্যের সাফাই গাইছি। রাজনীতির সঙ্গে চাঁদাবাজির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে যিনি যত বেশি চাঁদা তুলতে পারেন তিনি তত বেশি সফল প্রার্থী। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা চাঁদা দেন গোপনে, এই চাঁদা ভবিষ্যতে স্বার্থ উদ্ধারের বিনিয়োগ। সব রাজনৈতিক দল চাঁদার ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতারা বিনা পুঁজিতে যৌথ ব্যবসায় নাম লিখিয়ে রাখেন, কী ব্যবসা তাও জানেন না, কিন্তু মাসে মাসে টাকা পাচ্ছেন। সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর টাকা শুধু সদস্যদের চাঁদা থেকে সংকুলান করা যায় না। কেন্দ্রীয় নেতারা তাই ছাত্রদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন না। চাঁদা তুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা পার্টির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের অংশ, মূল দল এবং ছাত্রদের চাঁদাবাজি সমাজ মেনে নিতে পারলে মেয়েদের চাঁদাবাজিও মেনে নেয়া উচিত।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিদেশ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে কদর্য ভাষায় সমালোচনা হচ্ছে তারা অর্থ পায় কোথা থেকে? বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারের জন্য অশালীন ভাষায় অসত্য কন্টেন্ট নির্মাণে বাংলাদেশ থেকে সরকারবিরোধী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে যে অর্থের জোগান দিচ্ছেন তার একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে আবার ইডেন কলেজের ছাত্রীদের চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হচ্ছে। যারা ইডেন কলেজের চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার তাদের অনেকে আবার ঘুষ খান; চাঁদা আর ঘুষ খাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেউ অস্ত্র ঠেকিয়ে চাঁদা নিচ্ছেন, কেউ নথি ধরে রেখে ঘুষ নিচ্ছেন। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি মানুষের মোহ জাগে। এর জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদ। কেন্দ্রীয় নেতা তুষ্ট থাকলে বিভিন্ন ইউনিট কমিটির নেতাদের বেপরোয়া হয়ে উঠতে সময় লাগে না। নিজের সক্ষমতার চেয়ে আশীর্বাদের সামর্থ্য বেশি বলেই নেতার নেতৃত্বসুলভ আচরণে উদ্ধত ভাব বাসা বাঁধে। কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি চাউর করে দিয়ে ইউনিট নেতা তার কর্মী ও সমর্থকের সমীহ আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে ভয় আর আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।
ইডেন কলেজ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকার মহিলা কলেজগুলোর মধ্যে ইডেন কলেজ সবচেয়ে পুরোনো। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে জীবন উৎসর্গকারী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এই ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও এই কলেজের মেয়েদের অসামান্য অবদান রয়েছে। আজিমপুরে ১৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে বর্তমানে ৩৫ হাজার ছাত্রী পড়েন। কলেজটিতে ছয়টি ছাত্রীনিবাস রয়েছে, যেখানে মাত্র তিন হাজার ছাত্রী থাকতে পারেন। তাই সিট-বাণিজ্য হয়। নীতি-আদর্শের চেয়ে নেতা যখন বড় হয়ে যান তখন একটা মোহ তৈরি হয়। শুধু কর্মপন্থার প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ হলে তা মারামারির পর্যায়ে যায় না; কিন্তু এর নেপথ্যে যখন সিট-বাণিজ্যসহ নানা ধরনের চাঁদাবাজি বিরাজ করে তখন পার্টির আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের লক্ষ্যে তখন আধিপত্য বিস্তারের তোড়জোড় শুরু হয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় নেতারাও তখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কোন্দলরত দুই পক্ষকে গোপনে সমর্থন দিতে থাকেন। কলেজ বা হল কর্তৃপক্ষ নীরব ও নির্বিকার থাকে। গদি রাখার এই ভূমিকাই যথাযথ। পর্যাপ্ত হল নির্মাণে কারও কোনো গরজ নেই।
সরকারি দলের ছাত্ররা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব আবাসিক হলের দখলদারিত্ব সূত্রে মালিকানা স্বত্ব পেয়ে যান। বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ঢুকতে পারেনি, এখন ছাত্রদল ঢুকতে পারছে না। কী অপূর্ব সমঝোতা। একসময় বিএনপির ছাত্রদল এত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল, খালেদা জিয়া হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে বিএনপির প্রয়োজন নেই, ছাত্রদলই যথেষ্ট। জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজের দৌরাত্ম্য এত বেড়ে গিয়েছিল, এরশাদ সাহেব নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জাতীয় ছাত্রসমাজ অবলুপ্ত করে দেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তাতে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার হয়নি, কারণ বল্গাহীন ছাত্ররাজনীতির লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। সব সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা কেন থাকে এই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা।
সংবাদমাধ্যমকে দেয়া ইডেন কলেজের নেত্রী সামিয়া আক্তার বৈশাখীর বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ ও সাবেক ছাত্রী শাকেরা আরজু ফেসবুকে যা লিখেছে তা আরও বেশি অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা মেয়েদের অনেকের বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো ছাত্রীকে জোর করে দেহ ব্যবসা করানো প্রায় অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে ইডেন কলেজের মেয়েদের নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে, রাজনীতি হচ্ছে বলেই ইডেন কলেজের মেয়েদের উল্লেখ করে কাল্পনিক চরিত্র ও বর্ণনায় ঠাঁসা অনেক ভিডিও ক্লিপ। এসব ভিডিও তৈরি ও প্রচারে কিছু লোকের দারুণ উৎসাহ। আমাদের মেয়েরা ইডেন কলেজে পড়ে; তাই ইডেন কলেজের মেয়েদের নিয়ে যেভাবে ঢালাও মন্তব্য করা হচ্ছে, তাতে ইডেনের মেয়েদের প্রতি সমাজে একটা অমোচনীয় অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগবিরোধী কিছু লোক এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছে, ইডেনে পড়াশোনা করা ছাত্রী মানেই দুশ্চরিত্রা! এটা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, অভিভাবক হিসেবে আমাদের জন্যও লজ্জা এবং অসম্মানের। রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে যারা এই কাজগুলো করছেন, তাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক। সেই সঙ্গে ইডেন কলেজের মেয়েদের বিরুদ্ধে নৈতিকতা স্খলনের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা বন্ধ হোক।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা