একটি মানবগোষ্ঠী তার উদ্ভবকাল থেকে যতদিন পর্যন্ত সে টিকে থাকছে ততদিন যাপিত গোষ্ঠীজীবনে অসংখ্য বস্তু-উপাদান ও মনন-কল্পনাজাত ভাব-উপাদানের সম্মিলনে নিজের সংস্কৃতি নির্মাণ করে তোলে। জীবন যেহেতু তৈরি হয় স্থান, কাল ও পাত্রের চালচিত্রে তাই জীবন এক জায়গায় থেমে থাকে না, সমাজের মানুষ জ্ঞাতসারে কী অজ্ঞাতে পাল্টাতে-পাল্টাতেই এগিয়ে যায়। কালস্রোতে মানুষের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হয়, সামাজিক আচরণ ও অভ্যাসে ভিন্নতা আসে, শিল্পের সাধনায় বৈচিত্র্য দেখা দেয়, মোড়বদল ঘটে। খাদ্যের অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাস্তুনির্মাণ, ভাষা, ধর্ম, সামাজিক সংস্কার, এমনকি কুসংস্কার এবং মনের গড়ন ও কল্পনার ধাঁচ সবই একটি জাতির সাংস্কৃতিক উপাদান। জীবনকে বাদ দিয়ে তাই সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই। জীবন পাল্টে যেতে থাকলে সে কারণে সংস্কৃতির রূপও অন্যরকম হতে থাকে। আর জীবন পাল্টায় ঘটনার অভিঘাতে। ব্যক্তি মানুষের জীবন ও গোষ্ঠীজীবন উভয়ই। আর জনসমাজের বাইরে তো সংস্কৃতি নেই। জনগোষ্ঠীর প্রবহমান জীবনধারা, তার অভ্যাস ও সংস্কার, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বা বিচ্যুতি, তার বিশ্বাস বা সংশয় ইত্যাদি অজস্র বিষয় মিলে সমাজের যে মনোবিন্যাস তৈরি হয়ে ওঠে সেটিই প্রতিফলিত হয় সংস্কৃতির শরীরে। সমাজের চলন ঠিক করে দেয় তার ভেতরে বসবাসরত ব্যক্তি মানুষই কখনো কখনো বিশিষ্ট একক, কখনো বা বহুজনের সম্মিলনে রূপ নেওয়া সংঘ বা গোষ্ঠী। কিন্তু চলন তো নির্দিষ্ট চূড়ান্ত কোনো অবয়বে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে না।
একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক- আজ থেকে পুরো চল্লিশ বছর পেছনে যেতে হচ্ছে। আমি তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনগ্রাদ শহরে, এখন যা আদি নাম ফিরে পেয়ে সাংকৎ পিতের্বুর্গ (ইংরেজিতে এরই নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ) হয়েছে, বছরখানেকের জন্য গেছি। একটি পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। স্বামী-স্ত্রী ও শিশুপুত্র। তারাও গিয়েছিলেন বাইরে থেকে। ফের্নান্দ ভান দাম ছিলেন বেলজিয়ান, গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের মাস্টার। আমি ছিলাম একা, স্ত্রী-পুত্র ঢাকায় রেখে গেছি। ফের্নান্দ-আমি দুজনেই লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে, একই ক্লাসে। আড্ডাবাজ দুজনেই। ফলে ঘনিষ্ঠতায় বিলম্ব হয় না। ওরা (ছাত্রাবাসেই কিংবা বলা ভালো ছাত্রছাত্রী ভবন) আছেন, সেটাই নিয়ম, তবে যেহেতু বাসিন্দা একা নন, ৩ জনের সংসার, তাই কামরার আয়তন প্রয়োজনমাফিক যথেষ্ট বড়। আমার সান্ধ্য গল্পগুজব মোটামুটি ওদের সঙ্গেই হয়।
একদিন হঠাৎ ফের্নান্দ বলে বসেন, ‘হায়াৎ তোমার বৌ-বাচ্চার ছবি তো দেখালে না।’
আমি বলি, নেই তো! দেখাব কী?
তারপর ঢাকায় বউকে লিখি ছবি পাঠাতে, বন্ধু-বান্ধব তোমাকে দেখতে চাইছে। ছবি পাঠাও।
যে যুগের কথা বলছি তখন তো কম্পিউটার-ইন্টারনেট ইত্যাদি ছিল না, এমনকি মোবাইল ফোনও নয়। মস্কো-ঢাকা-মস্কোয় চিঠি যাতায়াত নিদেনপক্ষে মাসখানেকের ধাক্কা। ফলে মাস দুই-আড়াইয়ের মাথায় যখন বন্ধু দম্পতিকে স্ত্রীর ছবি দেখাই তারা বলে ওঠেন, তোমার বউ দেখতে বেশ। আমি বলি, তাই বুঝি? হবেও বা!
তাদের কৌতূহল মেটানোয় আমার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু ব্যাপারটা যে চুকেবুকে যায়নি তা বুঝলাম পরে। সময় আরও গড়িয়েছে। আমার চরিত্র কাঠামোয় ভারতবর্ষীয় মেজাজের এলেবেলে ভাব তারা ততদিনে বুঝে গেছেন এবং পশ্চিমি ফর্মালিটির চৌহদ্দির ত্রিসীমানায় আমরা নেই এমন সিদ্ধান্তে আসার পর একদিন মুখ খোলেন।
কিছু যদি মনে না করো, একটা জিনিস বলি।
বলো না, মনে করার কী আছে? অকপটে জিজ্ঞাসা করতে পারো, বিনা দ্বিধায় উত্তর দেবো।
ফের্নান্দ আমতা আমতা করে তার প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে চায়, ‘না মানে ঐরমযষু চবৎংড়হধষ, বুঝলে কি না, সে জন্যই...’।
হোক না পারসোনাল! কী আর এমন হাতিঘোড়া প্রশ্ন করবে যে জবাব দিতে আমার কষ্ট হবে?
বলেই ফেলি তবে, কেমন? দ্বিধা জয় করে বিশদ হতে চান বন্ধুবর, অনেক দিন আমাদের স্বামী-স্ত্রী তোমাকে নিয়ে কথা হয়েছে। আমরা আফসোস করেছি, আহা, এমন খাসা ছেলে, কিন্তু কপালের কী গেরো, দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো নয়, স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা নেই।
ও মা! বলে কী? চেয়ার থেকে আমার পড়ে যাওয়ার দশা প্রায়। আমি বলি, কেন মনে হয়েছিল এমন?
মনে হওয়াটা যে ভুল সে ব্যাপারে মনে মনে নিশ্চিত না হলে তো এই আলাপ পাড়া যেত না, তাই না? ঘটনাটা তোমাকে মনে করাই। আমরা তোমার বউয়ের ছবি দেখতে চাইলে তখনি যে দেখাতে পারোনি, প্রথম খটকা লাগে সেখানে।
অবাক হওয়ার পালা এবারে আমার। বলি, তোমরা দেখাতে পারো নাকি? বউয়ের ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘোরো নাকি? আশ্চর্য! তোমরা যেন কতই দেখাও!
কী বলে! এখন ভিরমি খাওয়ার জোগাড় আমার বিদেশি বন্ধুর, আলবৎ, ছবি নিয়ে ঘোরাফেরা করি। দেখবে? এই দেখো, বলেই মানিব্যাগ খুলল তার ভেতর থেকে ছবি বের করে তারপর ব্যাখ্যা দেয়, আমরা সব বিবাহিত পুরুষই স্ত্রীর ছবি বুকে নিয়ে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াই, বুকে নিয়ে মানে মানিব্যাগে নিয়ে, বুঝলে না!
কেন ঘোরো? কষ্ট হয় না?
আমার প্রশ্ন বুঝতে কষ্ট হয় তার। ধন্দে পড়ে গিয়ে বলে, কষ্ট? কেন, কষ্ট কিসের?
কষ্ট না? মানুষটি কাছে নেই, যে মানুষটিকে এত ভালোবাসি সে-ই কাছে নেই, তো ছবি কাছে রেখে কী লাভ? যতবার ছবিতে চোখ পড়বে ততবারই তো নতুন করে মন খারাপ হবে। হবে না? তুমিই ভেবে দেখো।
স্বীকার করে ফের্নান্দ, আমরা ঠিক এভাবে ভাবী না। সন্দেহ নেই আমাদের চেয়ে তোমাদের ভাবনার ধরন অনেক বেশি সংবেদনশীল। একটু থেমে পুনশ্চ যোগ করে, ব্যাপারটা কী, জানো, বিষয়টা ভালো-মন্দের নয়, এ হচ্ছে সংস্কৃতি ভিন্নতা।
আমার মনে পড়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর পর্যবেক্ষণ। নিয়মনিষ্ঠ কট্টর জাত জর্মনরা কখনো নাকি মনের আবেগ বাইরে খুলে এনে অন্যকে দেখায় না। যেমন- চিঠি এসেছে দারুণ দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে, কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু, চোখ ফেটে কান্না আসছে, বুক ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু সেই ভাঙন বাইরের লোক দেখবে কেন? জর্মনটি প্রক্ষালণ কক্ষে গিয়ে একচোট কেঁদে নিয়ে, তারপর হাতে-মুখে পানি ছিটিয়ে, মুছে, পরিপাটি হয়ে অন্যের সামনে হাজির হবে। শোকের ধরন একই, কিন্তু প্রকাশ ভিন্নতা সংস্কৃতির চেহারা চিনিয়ে দেয়। দুঃখে-শোকে আমরা কান্নাকাটি করি, সে তো সব মানুষই করে। কিন্তু সেই হাহাকারকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলা ভারতীয় সংস্কৃতি অভ্যাস সম্ভবত। কিংবা কে জানে, এমনও হতে পারে যে কৃষিভিত্তিক সামাজিক গড়ন এর মূলে রয়েছে, ফলে ভারতবর্ষীয় উপমহাদেশের সমাজই নয় শুধু, এ ধরনের সমাজ যে দেশে বা যে জনগোষ্ঠীর ভেতরে আছে সেখানেই এমনটি দেখা যাবে বলে মনে হয়।
জনসমাজের বাইরে তো সংস্কৃতি নেই। জনগোষ্ঠীর প্রবহমান জীবনধারা, তার অভ্যাস ও সংস্কার, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বা বিচ্যুতি, তার বিশ্বাস বা সংশয় ইত্যাদি অজস্র বিষয় মিলে সমাজের যে মনোবিন্যাস তৈরি হয়ে ওঠে সেটিই প্রতিফলিত হয় সংস্কৃতি শরীরে। সমাজের চলন ঠিক করে দেয় তার ভেতরে বসবাসরত ব্যক্তি মানুষই- কখনো কখনো বিশিষ্ট একক, কখনো বা বহুজনের সম্মিলনে রূপ নেয়া সংঘ বা গোষ্ঠী। কিন্তু চলন তো নির্দিষ্ট চূড়ান্ত কোনো অবয়বে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে না। চলন পাল্টায় বহু কিছুর চাপে-প্রশ্রয়ে-সংক্ষোভে।
অন্তরালবর্তী কার্যকারণ তো থাকবেই, থাকতে বাধ্য, বড় কথা হলো ওই চলনের চলিষ্ণুতা। মানুষ পাল্টালে সমাজ পাল্টাবে, সমাজ পাল্টালে সংস্কৃতি পাল্টাবে। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি সাধারণ মানুষের সাধারণ চর্মচক্ষুতেই ধরা পড়ে। এই রূপান্তর কি পরিবর্তন কিন্তু এত ধীরগতিতে ঘটতে থাকে যে সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না, বেশ কিছুটা সময় পার হলে তখন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিতে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের সমাজ যে আগের জায়গায় অনড় হয়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসে নেই, এই বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পণ্ডিত হতে হয় না, সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। পৃথিবী এখন কব্জা করে রেখেছে অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং দুটির কোনোটিই কেবল দৈশিক নয়, আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিকও। এর ফলে বিশ্বায়নের ছিদ্র দিয়ে বহির্বিশ্বের চিন্তা ও জীবনপ্রবাহ যেভাবে আমাদের জীবনে এসে ঢুকছে তা রোধ করার সাধ্য কারও হাতে নেই এবং সবই যে খোলা কর্দমাক্ত বেনো জল আমার সাংস্কৃতিক অমলিনতা কলুষিত করার জন্য সবেগে ছুটে আসছে এমনও নয়। প্রশ্ন হলো- বিবেচনা শক্তির, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উভয়েরই। খাদ্যবস্তু যত উত্তম, দুর্মূল্য ও বিখ্যাতই হোক না কেন, নিজের পরিপাকশক্তি হিসেবে না রাখলে তা গ্রহণ শারীরিক বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ডাক্তারি শাস্ত্রে অ্যালার্জি বলে একটা কথা আছে, এটি কোনো অসুখ নয়, কোনো বিষক্রিয়া জীবাণু-ভাইরাস ইত্যাদি এর উৎস নয়। নির্দিষ্ট একক কোনো ব্যক্তির দেহ বা শারীরবৃত্ত যা গ্রহণে অনিচ্ছুক ও তীব্র শারীরিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সেটিই অ্যালার্জি।
আমার সমাজদেহের প্রকৃতি ও স্বভাবগত ক্ষমতা সে কারণেই সম্যকরূপে জানা থাকতে হবে, অন্যথায় বহিরাগতের কোনো অভিঘাত বা প্রভাবে ভারসাম্যহীনতা, ক্ষয়, বিনষ্টিপ্রবণতা ইত্যাদি এসে হাজির হতেই পারে। আত্তীকরণে ব্যাঘাত হলেই অনাসৃষ্টি দেখা দেবে। আত্তীকরণ প্রক্রিয়া কিন্তু জবরদস্তিতে হয় না, হয় স্বভাবধর্মের চাহিদাতে। ফলে মানুষ ও সমাজ সেটাকেই আত্মস্থ করে যার চাহিদা ভেতর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতির ভাঙা-গড়া, অর্জন-বিসর্জন ইত্যাদি কালধর্ম ও সমকালীন মানুষের স্বভাবধর্ম অনুযায়ীই ঘটে থাকে। এই সত্য অনুধাবন ও মান্য করলে সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা বা দুশ্চিন্তার সুরাহা মিলবে। গণতন্ত্রও বিকাশ লাভ করবে।
লেখক: সাহিত্যিক
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা