আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৪:০৩
ডিজিটাল অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই
আতিউর রহমান

ডিজিটাল অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই

আতিউর রহমান

করোনা সংকটকালে আমরা ঠেকে শিখলাম যে, প্রকৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখতে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই। সবার কাছে সহজেই সাশ্রয়ী মূল্যে অর্থ পৌঁছানোর আরেক নাম অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় এ লক্ষ্য পূরণ আগের চেয়ে অনেকটাই সহজ হয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের সংযোগ বেড়ে যাওয়ায় তাকে ঘিরে নয়া ধাঁচের আর্থিক সেবা প্রদানের সুযোগ অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। ২০০৭-০৮-এর বিশ্ব আর্থিক সংকটের পর থেকেই বিশ্বের অনেক দেশই প্রকৃত অর্থনীতি তথা কৃষি, খুদে ও মাঝারি শিল্প এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশে তাদের কাছে বাড়তি অর্থপ্রবাহের গুরুত্ব বেশি বেশি অনুভূত হতে থাকে। বাংলাদেশ অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে গভীরভাবে অনেকের কাছে অর্থ পৌঁছে দেয়ার প্রয়োজনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নয়া ধাঁচের অর্থ লেনদেনের ওপর জোর দিতে শুরু করে। বিশ্ব আর্থিক সংকটের সময় শুধু স্বল্পমেয়াদি আর্থিক পণ্য বা সেবা দিয়ে উন্নত বিশ্ব যেভাবে নয়া উদারনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে, তাতে প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ‘আমরা ৯৯ শতাংশ বনাম ওরা ১%’ শিরোনামে ওয়ালস্ট্রিটনির্ভর আর্থিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুষ্টিমেয় ধনিকের হেলিকপ্টারে করে টাকা নেয়ার এ কৌশলের বিপরীতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশেই গরুর গাড়িতে করে কৃষক, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছে অর্থ নিয়ে যাওয়ার এক নয়া কৌশল গ্রহণ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং কৌশল চালু করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে তার প্রধান ব্যাংকিং কৌশল হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দশ টাকার হিসাব খোলা, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্যাংকিং সুযোগ সৃষ্টি করা, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং সূচনা করা, কৃষি ঋণ দিতে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোকেও ‘প্রণোদনা ও নির্দেশনা’ দিয়ে মাঠে নামানো এবং আর্থিক খাতের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূল ধারায় নিয়ে আসার মাধ্যমে এক নয়া ধাঁচের উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের নয়া মডেল দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এর সুফল বাংলাদেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হওয়ায় বিশ্ব আর্থিক সংকটের ঝাপটা আমাদের অর্থনীতিতে সেভাবে লাগেনি। ভোগের পরিমাণ কমেনি। বরং বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদাও সে কারণে বেড়েছে। আর তাই মাথাপিছু নমিনাল জিডিপির হার পুরো এশিয়ায় সর্বোচ্চ থেকেছে বাংলাদেশ। ২০১১-২০১৮ সময়টায় এ হার ৯.৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল ছিল পুরো ২০১০-এর পরের দশকজুড়েই। এ সময়টায় কৃষি ও এসএমই ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। রপ্তানি খাতে বিশেষ সমর্থন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফসহ বিভিন্ন আর্থিক সমর্থন দিয়ে। তা ছাড়া প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য নিয়মনীতি সহজ করা হয়। হুন্ডিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। ফলে এ সময়টায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাঁচগুণের মতো বেড়ে যায়। তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি পাঁচ থেকে ছয় শতাংশের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। যদিও হালে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বিশ্ববাজারে তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। তা ছাড়া কোভিড মোকাবিলার জন্য অর্থনীতিতে প্রচার তারল্য ঢালতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এবং সরকারকে। এসবের চাপও মূল্যস্ফীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে।

এতকিছুর পরও বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে এখনই বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের চাকা বেশ দ্রুতলয়েই ঘুরছে। তবে রেগুলেটরদের চোখ-কান সর্বদাই খোলা রাখতে হবে। বাংলাদেশের এ নয়া ধাঁচের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞ মহল। লন্ডনের ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে’র সহযোগী ‘দ্য ব্যাংকার’ এবং ‘ইউরোমানি’র সহযোগী ‘দ্য ইমার্জিং মার্কেটস’ ২০১৫ সালে এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের সেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে পুরস্কৃত করেছিল। ২০১৩ সালে বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেরাল্ড এপস্টেইন ‘রিভিউ অব কেইনসিয়ান ইকোনমিক্স’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং বিষয়ে একটি আগ্রহ উদ্দীপক লেখা লিখেছেন। ওই লেখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর একটি ‘কেস স্টাডি’ ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নয়া-উদারনৈতিক ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য যে নয়া ধাঁচের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের কৌশল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করেছে তা সারাবিশ্বেই ছিল অগ্রণী। বিশ্ব আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এ কৌশল খুবই কাজে লেগেছিল। তার মতে, এ কৌশলের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অভিযান, কৃষি ঋণ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া, বর্গাচাষিদের জন্য বিশেষ ঋণের উদ্ভাবন, সবুজ ঋণের প্রতি সমর্থন, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য পুনঃঅর্থায়ন, রপ্তানি শিল্পের জন্য বিশেষ ঋণ সমর্থন, সবুজ ব্যাংকিংয়ের জন্য গাইডলাইন জারি করা এবং সর্বোপরি এসব উদ্ভাবনীমূলক ঋণ সত্যি সত্যি উদ্যোক্তাদের কাছে যাচ্ছিল কিনা তার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান সাফল্য দেখাতে পেরেছিল তাদের নয়া শাখা খোলার অনুমতি ত্বরান্বিত করা এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অধ্যাপক এপস্টেইন এ অভিজ্ঞতা থেকে সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও চিহ্নিত করেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : জাতীয় প্রয়োজনে বাস্তবানুগ উদ্যোগ নেয়া যায়, বিশেষ বিশেষ এলাকা ও জনগোষ্ঠীর দিকে ঋণকে প্রবাহিত করা সম্ভব, শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নয় আরও বড় উন্নয়ন পরিসরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করতে পারে এবং সেজন্য নতুন সব ‘রেগুলেটরি টুলস’ ব্যবহার করতে পারে, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশের মতো উন্নয়নধর্মী লক্ষ্যমাত্রাও (যেমন কৃষি ঋণ প্রবৃদ্ধি, সবুজ ঋণ প্রবৃদ্ধি, সিএসআর ও এসএমইর প্রবৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্যের হার ইত্যাদি) নির্ধারণ করতে পারে, সরকারের অন্যান্য ম্যাক্রো অর্থনৈতিক নীতি এবং উন্নয়ন কৌশলগুলোর সমন্বয় জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের মাঝে সম্পর্কটা কেমন হবে তা অনুধাবনে সাহায্য করা এবং ব্যাংকিং খাতের সক্ষমতার সঙ্গে অন্য অংশীদারদের সক্ষমতার মেলবন্ধন ঘটানোরও বেশ প্রয়োজন রয়েছে।

অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের এ প্রশংসা নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া। তবে এক দিনেই তো আমাদের আর্থিক খাতের এসব উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করেই আমাদের এগোতে হয়েছে। এখনো যে সে ধারাটি চালু রাখা গেছে সেটিই মুখ্য বিষয়। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা নেই। অবশ্য খেলাপি ঋণের রকমফের, পরিচালনা পর্ষদের অনিয়ম, কতিপয় ব্যাংকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সুশাসনের অভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে ব্যাংকিং খাত, বিশেষ করে সুদূরপ্রসারী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

এ প্রেক্ষাপটেই আজও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অর্থায়নের কৌশল নিয়ে ব্যাংকিং খাত এগিয়ে চলেছে। আছে সীমাবদ্ধতা। আছে দুর্নীতি। আছে অনিয়ম। তবুও তো সমাজের পিরামিডের নিচের দিকের মানুষের কাছে প্রচলিত ও নয়া ধাঁচের লেনদেন ব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ যাচ্ছে। কৃষি ঋণ বাড়ছে। প্রবাসী আয় অল্প সময়েই উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এমনকি একজন ভিক্ষুকও এখন মোবাইল ব্যাংকিং করছে। রিকশাওয়ালারা তো হরহামেশায় ব্যাংকিং করছে। স্কুলের বাচ্চারা, পরিবেশ কর্মীরা, পথশিশুদের জন্যও ব্যাংকিং করার অধিকার প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে।

এই যে নয়া যুগের নয়া ধাঁচের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের এতটা প্রসার ঘটেছে বলেই না করোনা সংকটকালেও গরিব মানুষসহ প্রায় সবাই তাদের লেনদেন চব্বিশ ঘণ্টাই চালু রাখতে পেরেছেন। আর্থিক লেনদেনের এ অসাধারণ গতি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও তাই এতটা গতিময় করে রেখেছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমনটা সম্ভব হয়নি। কী করে আমাদের আর্থিক খাতের এ নবধারার সূচনা হলো?

মনে পড়ছে ২০০৯ সালের শুরুর দিকের কথা। সেই সময়টায় উন্নত কয়েকটি দেশের বেসামাল অর্থায়নের কারণে বিশ্ব আর্থিক সংকট মধ্যগগনে। আমরা সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ অভিযানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করেছিলাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পুরো ব্যাংকিং খাতকে জড়িয়ে সংশ্লিষ্ট জনসম্পদের মন বদলের উদ্যোগ নিয়েছিল। সে ধারা এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের লক্ষ্য ছিল মাটিকে স্পর্শ করা। উৎপাদনশীল খাতকে চাঙ্গা রাখা। অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদাকে ঝিমিয়ে না পড়তে দেয়া। এ কৌশল আমরা আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ করেছিলাম। ব্যাংকার ছাড়াও অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারদের আলাপ করে মুদ্রানীতি ও ঋণনীতির (বিশেষ করে কৃষি ও এসএমই ঋণনীতি) কৌশল নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যেসব খাত বা গোষ্ঠীর কাছে অর্থ যাচ্ছিল না, সেসব খাত বা গোষ্ঠীর দিকে নতুন করে অর্থপ্রবাহের নয়া উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমরা। নয়া জামানার নয়া প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংকিং খাতের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়নে আমরা ব্রতী হই। ফলে শাখাবহির্ভূত অনলাইন/মোবাইল ফোন/স্মার্টকার্ডনির্ভর আর্থিক সেবা প্রদানের দুয়ার দ্রুতই খুলতে থাকে। পাশাপাশি এ নয়া ধাঁচের ব্যাংকিংয়ের জন্য নয়া নয়া গাইডলাইন/প্রজ্ঞাপন তৈরির আগে অংশীদারদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। একই সঙ্গে গ্রামীণ শাখা/উপশাখা/বুথ এবং এজেন্টদের মাধ্যমে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পরিধি বাড়াতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবুজ অর্থায়নের জন্য ‘ম্যাক্রো প্রুডেন্সিয়াল’ বা সামষ্টিক বিচক্ষণতা প্রয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। এসএমই ও সবুজ উদ্যোক্তাদের জন্য কম খরচের পুনঃঅর্থায়নের কৌশল গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এ কৌশল এবারের অতিমারির সময় খুবই কাজে লেগেছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রণোদনা কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়নে ডিজিটাল অর্থায়নের কৌশলগত ব্যবহারে তাদের পারদর্শিতা দেখিয়েছে। আর তাই এ সংকট থেকে পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ আশপাশের অনেক দেশ থেকে ভালো করছে। এ পুনরুদ্ধারের গতি আরও বাড়ানো যেত যদি আমরা সময়মতো টিকা পেতাম। এ জায়গায় বিশ্ব তার নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও আমাদের নেতৃত্ব যেভাবেই পারেন টিকা সংগ্রহে কখনই দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এর সুফলও আমাদের অর্থনীতি পাচ্ছে। এ সংকটকালে ব্যাংকিং খাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করে সরকার তার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এখনো কোভিড-১৯ ঘিরে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি। উন্নত বিশ্বে এ রোগের সংক্রমণ বাড়ছে। আর উন্মুক্ত সীমান্তের এ পাড়ে বাংলাদেশকেও তাই খুবই সতর্ক থাকতে হবে। সে কারণেই আমাদের সরকার ও উদ্যোক্তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দিকে বেশি বেশি নজর দিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ভালো ছিল বলেই এ সংকটকালেও আমরা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এগিয়ে যেতে পেরেছি। এ অর্জন ধরে রাখতে হবে। সে কারণেই আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকবচ কৃষির দিকে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রখর নজর বজায় রাখতে হবে। সরকারের হাতেও বাড়তি অর্থ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ‘ব্যালেন্সশিট’ সম্প্রসারণ করে যেভাবে সক্রিয় ছিল, সে ধারা থেকে সরে আসার সময় এখনো আসেনি। টাকার ওপর চাপ বাড়ছে। আমদানি বাড়ছে বলে ডলারের দাম বাড়ন্ত। রেমিট্যান্সও আগের বছরের মতো আসছে না। তাই অনেক বেশি বিচক্ষণতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার বিদেশি মুদ্রার লেনদেন নিশ্চিত করে যেতে হবে। প্রয়োজনে ডলার বিক্রির বর্তমান ধারা আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশে যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার বেড়েছে সারা বিশ্বই এখন তা জানে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরই কোনো না কোনো আর্থিক সেবা গ্রহণের সুযোগ ছিল। ২০১৩ সাল থেকে এ সুযোগ ৫৭ শতাংশ বেড়েছিল ওই বছর। এখন হয়তো আরও বেশি। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইলভিত্তিক আর্থিক উদ্যোগ বা ‘ফিনটেক’কে কাজের সুযোগ করে দেয়। যারা প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা পাচ্ছিলেন না তাদের কাছে টাকা পৌঁছানোর এ অভিনব উদ্যোগ পুরো আর্থিক ‘ল্যান্ডস্কোপ’টাকেই বদলে ফেলেছে।

ডিজিটাল অর্থায়নের সুযোগ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণের অংশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয় সিআইবি, ক্লিয়ারিং হাউস, ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ, বিএফটিএন, আরটিজিএস, ইলেক্ট্রনিক কেওয়াইসি, অনলাইন সমন্বিত সুপারভিশন, এডি ব্রাঞ্চগুলোর হাতে অনেক ক্ষমতা হস্তান্তর, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং গাইডলাইন চালু করাসহ অসংখ্য নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসবের সুফল আমরা এখন বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করছি। কোনো কোনো ব্যাংক এরই মধ্যে ব্লকচেইন প্রযুক্তিও গ্রহণ করতে শুরু করেছে। সব ব্যাংকই এখন কোর ব্যাংকিং সলিউশন ব্যবহার করছে। ফলে আর্থিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ তার সাফল্য দেখিয়েই চলেছে। আইএমএফের সর্বশেষ ‘ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকসেস সার্ভে’ থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ২০২০ সালে ৮.৯৯টি ব্যাংক শাখা আছে। ২০১৪ সালে তা ছিল ৮.৬১টি। একই পরিমাণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটিএম সংখ্যা ২০২০ সালে ১০.১৮টি। ২০১৫ সালে তা ছিল ৭.০৯টি। এক হাজার কিলোমিটারের মধ্যে ২০২০ সালে মোবাইল এজেন্ট ছিল ৮,১৪১টি। ২০১৫ সালে তা ছিল ৪,৪০৮টি। ২০২০ সালে মোবাইল লেনদেনের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২০.৪৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা ছিল ১১.০২৬%। এ ছাড়া দুই কোটি কৃষি ও অতিদরিদ্র মানুষের রয়েছে দশ টাকার ব্যাংক হিসাব। আর মোবাইল ব্যাংকের হিসাব তো রয়েছে ঘরে ঘরেই। তাই লকডাউনের সময় পোশাক শ্রমিক ছাড়াও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে থাকা প্রান্তজনের কাছে সরকারি সহায়তা পাঠাতে অসুবিধা হয়নি। আর মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ফলে তো আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে মিনি বিপ্লবই ঘটে গেছে। এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী নেতৃত্বের কথা না বললেই নয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর সময়ে দেড় কোটি নতুন মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলেছেন। এখন প্রায় দশ কোটি মানুষের এ হিসাব রয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রসারও সমান তালেই ঘটেছে। ২০২০ সালে ১৪ হাজার এজেন্ট আউটলেট ছিল। এক বছর আগেও তা ছিল দশ হাজার।

ওপরের এ বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থায়ন কী গতিতে প্রসারিত হয়ে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনকে শক্তিশালী করে তুলছে। আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এ অভিনব অভিযাত্রায় করে করেই শিখেছি। এখনো শিখছি। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডিজিটাল অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে বরাবরই যত্নবান থাকতে হবে। বিভিন্ন আর্থিক সেবা যাতে ‘ইন্টার অপারেবল’ করা যায়, সেদিকে সর্বদাই নীতি-নজর থাকা জরুরি। গ্রাহকদের সুবিধা ও আস্থা ধরে রাখার জন্যই তা জরুরি। নয়া বাস্তবতায় গ্রাহকরাই যেন সর্বোচ্চ সুরক্ষা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। ই-কমার্স জগতে কিছু সংখ্যক জালিয়াতকারীর বাড়াবাড়িতে গ্রাহক আস্থায় বেশ খানিকটা চিড় ধরেছে। সরকার অবশ্য এ অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা ডিজিটাল অর্থায়নের সক্ষমতা ও সুনাম যাতে কোনোমতেই নষ্ট না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি কপ-২৬-এ বাংলাদেশ ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’য় অর্থায়নের যে রূপরেখা পেশ করেছে তাকেও বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবুজায়নের উদ্যোগগুলোকে আরও জোরদার করতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজারও দীর্ঘমেয়াদি সবুজ বন্ড পরিচালনাসহ খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহী করতে পারে। সব মিলেই আমাদের জলবায়ুবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের পথে হাঁটতে হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর