আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০৮:২৬
ভেনামি জাত ও ক্লাস্টার পদ্ধতি সাফল্য আনবে চিংড়ি চাষে
ফারাজী আজমল হোসেন, সাতক্ষীরা থেকে

ভেনামি জাত ও ক্লাস্টার পদ্ধতি সাফল্য আনবে চিংড়ি চাষে

বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি খাতে আগে ইলিশের পরেই ছিল চিংড়ির অবস্থান। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভাইরাসের আক্রমণ আর চাষজনিত নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে চিংড়ি হারিয়ে ফেলেছে সেই সুদিন। এ খাতে সাত নম্বরে পিছিয়ে যাওয়া চিংড়িকে আবারও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে চলছে গবেষণা। চিংড়িচাষিদের তাই চোখ মৎস্য কর্মকর্তাদের দিকে। কর্মকর্তারা বলছেন, বদলে যাওয়া জলবায়ু আর চাষাবাদ মাথায় রেখে শুধু প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে মিশ্র বা আধুনিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করা উচিত। তাই এখন ভেনামি জাত ও ক্লাস্টার পদ্ধতিই চিংড়ি চাষে আনবে সাফল্য।বাংলাদেশে বেশ সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আশির দশক ধরে আলোচনায় রয়েছে মৎস্য খাত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এ খাতে বেশ দ্রুত উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাছ মারা যাওয়া, চিংড়ি প্রক্রিয়ার খরচ বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারণে ধুঁকছে এই সম্ভাবনাময় খাতটি। সেই সঙ্গে নতুন জাতের চিংড়ি, আধুনিক ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষসহ চিংড়ির নতুন বাজার সৃষ্টির কারণে সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে চিংড়ির বাজার ঘিরে।সরেজমিন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন ঘেরগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিগত ১৪ বছর ধরেই কম-বেশি সমস্যার মধ্যে থেকে চিংড়ি চাষ করে যাচ্ছে তারা। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার ক্ষতি মোকাবিলার পর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও করোনার মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না চিংড়িচাষিরা।

এ অঞ্চলে ১০ বিঘার ঘেরে (চিংড়ি চাষের পুকুর) চাষ করা বকুল বলেন, গেল বছরগুলোতে মাছ মোটামুটি উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু দাম কম ছিল। চলতি বছর মাছের দাম তুলনামূলক বেশি, কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে কম। এ বছর দেরিতে বৃষ্টি হওয়ায় ঘেরগুলোতে মাছে ভাইরাসের প্রকোপ বেশি।

স্থানীয়ভাবে সাতক্ষীরার এ অঞ্চলে অন্যান্য ঘের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর সুন্দরবনসংলগ্ন ঘেরগুলোর ৯০ শতাংশ মালিক লাভের চেয়ে খরচ তুলতে পারলেই খুশি। তবে তাদের আশঙ্কা, লিজ নিয়ে যারা যন্ত্রের সাহায্যে পানি তুলেছেন- তারা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।

স্থানীয় পর্যায়ের তথ্য অনুসারে, সনাতনী পদ্ধতিতে যে ঘেরগুলোতে নদী থেকে সরাসরি পানি প্রবেশ করানো হয়, সেখানে ভালো সাদা মাছ পাওয়া যায়। চিংড়িতে পর্যাপ্ত লাভ না হলে সেটা পুষিয়ে যায়। কিন্তু এ ধরনের ঘেরের জমি লিজ নিয়ে চাষ করলে লাভের পরিমাণ অনেক কমে যায়। কেননা এ ধরনের ঘেরে জমির মালিককে বিঘাপ্রতি বছরে দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা। কোনো কোনো স্থানে তা আরও বেশি। অন্যদিকে সেচ দিয়ে যে ঘেরে চাষ করতে হয়, সেখানে ১০ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি বছরে দিতে হয়। স্থানীয় ভাষায় এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘হাড়ি’।

সাতক্ষীরা-যশোর অঞ্চলে অবশ্য লোনাপানির এই বাগদার পাশাপাশি গলদা চিংড়িও উৎপাদন করা হচ্ছে। কিছুটা ভিন্ন চিত্র বর্তমানে রয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের চিংড়ি ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে সনাতনী পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদনের জন্য সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করা হয়, বাড়তি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বর্তমান সময়ে এ পদ্ধতিতে কাজ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এর বদলে মিশ্র প্রক্রিয়া বা আধুনিক প্রক্রিয়া ব্যবহার যুক্তিযুক্ত হবে বলে পরামর্শ দেয় তারা।

একসময় দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য ছিল চিংড়ি। কিন্তু গত কয়েক বছরে এটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এখন চিংড়ি দেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, সাত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে চিংড়ি রপ্তানি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশ থেকে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হয় ৪০ হাজার ৭০২ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি করা হয় ৩৯ হাজার ৭০৬ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ১৬৮ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৩০৬ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৩৬ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৫৭১ টন। বিগত কয়েক বছরের গড় রপ্তানির হার হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ করে। এ অবস্থা চলতে থাকলে চিংড়ি রপ্তানি তলানিতে এসে ঠেকার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
অথচ মাছ উৎপাদনে দীর্ঘদিন পঞ্চম অবস্থানে থাকার পর বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে (৬ বছর ধরে পঞ্চম অবস্থানে ছিল) রয়েছে। এটি মৎস্য খাতের অনন্য এক অর্জন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ছাড়াও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ইলিশ আহরণে প্রথম (বর্তমানে ইলিশের মোট উৎপাদন ৫ দশমিক ৭১ লাখ টন) অবস্থানে রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা মৎস্যজাত পণ্যের প্রায় ৭০ ভাগ ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্টস। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত আইকিউএফ, কুকড, ফিস ফিলেট ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্য জাতীয় পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে মূলত গলদা, বাগদা, হরিণাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, শুঁটকি, মাছের আঁশ, কাঁকড়া এবং চিংড়ির খোলসও রপ্তানি হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরচুন বিজনেস ইনসাইটের মতে, ২০২৮ সাল নাগাদ বৈশ্বিক চিংড়ির বাজার দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। তবে অর্থবছরের প্রথম নয় মাস, অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে চিংড়ি রপ্তানিতে আয় কমেছে ২০ শতাংশ।

এ ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষে আবারও সফলতা আনতে আধুনিক দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে বিগত বছরগুলোতে। এর মধ্যে একটি হলো ভেনামি জাতের চিংড়ি উৎপাদন এবং অপরটি ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষাবাদ।

গেল বছর বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ির চাষাবাদের অনুমতি প্রদান করে সরকার। বর্তমানে যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে এ পদ্ধতিতে কিছু ঘেরে চাষাবাদ করা হচ্ছে। দেশে ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় ২০১৯ সালে। চার বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর অনুমোদন প্রদান করে সরকার। ভেনামি চিংড়ি উচ্চ ফলনশীল জাতের চিংড়ি, যাকে অনেকটা ফার্মের মুরগির সঙ্গে তুলনা করা যায়। এটি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের একটি চিংড়ির প্রজাতি। উচ্চ ফলনের পাশাপাশি এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত চিংড়ির ৮০ শতাংশই ভেনামি জাতের।
‘হোয়াইটলেগ শ্রিম্প’ বা সাদা পায়ের চিংড়ি হিসেবে পরিচিত ভেনামি দেখতে আমাদের দেশের স্থানীয় জাতের হরিণা চিংড়ির মতো। ফলে প্রথম দেখায় এ চিংড়িকে হরিণা ভেবে ভুল করেন অনেকে। তবে এ জাতীয় চিংড়ি চাষের ঝুঁকি হলো ফার্মের মুরগির মতোই তার খাদ্যাভ্যাস ও আবহাওয়া বিবেচনায় রাখতে হয়।

ভেনামি চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনায় জৈব নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে হয়। পানি ও বর্জ্য শোধন, ভৌত অবকাঠামোর বিচ্ছিন্নতা, বায়ু সঞ্চালন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, রোগের তথ্য সংরক্ষণ, খাদ্য প্রয়োগ- এসব বিষয়ে নিবিড় নজরদারি রাখতে হয় যা সনাতনী পদ্ধতিতে করা হয় না।

চিংড়ি রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্যমতে, সঠিকভাবে ভেনামি চাষ করা গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে দেশের রপ্তানি আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব।

চিংড়ি চাষে অপার সম্ভাবনাময় আলোচনাটি ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষাবাদ নিয়ে। এ প্রসঙ্গে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ক্লাস্টার হলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত খামার সমষ্টি, যা সাধারণত একই অঞ্চল ও পরিবেশে খুব কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত হয়। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে খামারগুলোর মধ্যে সমবৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য।

এ পদ্ধতিতে চাষ করলে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন করা সহজ চিংড়ি চাষে পানির উৎস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ সহজতর ও সাশ্রয়ী হয়। কারিগরি সহায়তা প্রাপ্তি অনেক সহজ হয়। জৈব নিরাপত্তা প্রতিপালনের মাধ্যমে রোগ-বালাই প্রতিরোধ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। সম্মিলিতভাবে গুণগত মানসম্পন্ন উৎপাদনসামগ্রী সংগ্রহ করা যায় এবং উৎপাদন খরচ কমানো যায়।