এই লেখাটি কোনো একাডেমিক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পন্ডিতি মানদন্ডে লেখা রচনা নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে শুরু করে চোখে দেখা অর্ধ শতকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অজস্র ঘটনাবলির আলোকে একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি মাত্র। এতে যৎসামান্য ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে উঠে এলেও আত্ম উপলব্ধির বয়ানে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। আমি জানি আমার এই ব্যক্তিক উপলব্ধি হয়তো সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য হবেনা। যদি হয় আনন্দিত হব।
এই রচনার বিষয়বস্তু শেখ হাসিনার সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্যা শেখ হাসিনার সংগ্রাম বিদেশের মাটিতে প্রায় ছয় বছর নির্বাসন শেষে যিনি স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে, এবং সেদিন থেকেই জড়িয়ে পড়েন অন্তহীন রাজনীতির সংগ্রামে । জাতীয় স্বাধীনতার রণাঙ্গনে যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে কলম ও ক্যামেরা আমার সঙ্গি হয়েছিল। হয়তোবা সে কারণেই দেশ স্বাধীনের পরক্ষণে পেশাদারি সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি। সেই সুবাদে সুযোগ ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপস্থিত থেকে সেদিনের নবীন সংবাদকর্মি হিসেবে বন্ধুবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর লেখার। স্পষ্ট মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তণের প্রায় বছর দশেক পর তাঁরই কণ্যা যেদিন ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন, সেদিন উদ্বেলিত লাখো মানুষ তাদের হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তকে। গণমানুষের সেই আবেগের মধ্যে ছিল অনেক স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন এক স্বপ্নদেখা, নতুন আশায় বুক বাঁধা।
গণমানুষের সেই স্বপ্নভঙ্গ এবং প্রত্যাশার প্রেক্ষাপট কারও অজানা নয় । কেবল দলীয় নেতাকর্মি নন, বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে তাঁরই কণ্যাকে স্বাগত জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ ; যে মানুষ জাতির পিতার ধমনী বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে পরিপূর্ণ আবেগ ও ভালোবাসায় ; যে মানুষ জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার চায়, যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি চায়, যে মানুষ মনেপ্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পুন:প্রতিষ্ঠা চায়, ফিরে পেতে চায় লাখো শহীদের বাংলাদেশকে।
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে প্রায় স্বপরিবারে নিহত হলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক। ঘুরিয়ে দেওয়া হল সদ্য-স্বাধীন দেশের স্বাভাবিক ইতিহাসের চাঁকা। শুধুমাত্র দেশের বাইরে অবস্থানের কারণেই বেঁচে থাকলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। ভয়াবহ সে হত্যাকান্ড জাতিকে স্থম্ভিত এবং চরম হতাসায় নিমজ্জিত করে । সেই সুযোগে সেনাপতি শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের রক্তরঞ্জিত স্বদেশকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে ; গুড়িয়ে চলে পাকিস্তানি স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক একটি স্তম্ভ। যে আওয়ামি লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাকে রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলে ছিন্নভিন্ন করার প্রচেষ্টা চালায় সামরিক শাসক। চারদিকে এক সর্বগ্রাসী হতাসা তখন, শুধুই প্রশ্ন : বাংলাদেশ কি মুক্তি পাবে ভয়ংকর এই মহাপ্রলয় থেকে ? আছেন কি কোনো ত্রাতা, যিঁনি হাল ধরবেন ঝড়ের উত্তাল সাগরে?
অতএব বঙ্গবন্ধু কণ্যার রাজনীতি অধিষ্ঠানের মধ্যে বহু প্রার্থীত এক জাতীয় নবজাগরণ আছে, রাষ্ট্রের নব অভিযাত্রা আছে, যার ধারাবহিকতায় জাতীয় স্বাধীনতার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হলেন শেখ হাসিনা। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু কণ্যার স্বদেশে ফিরে আসা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নতুন যুগের সূচনা করে ।
ইতিহাসের আর্শিবাদ
স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি মহলের যোগসাঁজসে রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করে বাংলাদেশকে যেভাবে অকেজোÑঅর্থহীন করার চেষ্টা হয়েছিল, যে প্রক্রিয়ায় সদ্যÑস্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাভাবিক যাত্রাপথ রুদ্ধ করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে যেভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল,বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই ভয়ংকর অশুভ ধারার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করে সামরিক ও নবজাগরিত সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে । ইতিহাসের সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধুর এই জ্যেষ্ঠ কণ্যা জাতির লুণ্ঠিত গৌরব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অধিনায়কত্ব দান করেছেন যা তাঁর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সাফল্য।
সে কারণেই তাঁর রাজনীতিতে আসা এক আশির্বাদ, এবং একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের জন্যে অভিসাপও। ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে চাঁপ চাঁপ রক্তের দূ:সহ চিহৃ দেখতে হয়েছে তাঁকে বুকভাঙা কান্নায়। অথচ তাঁর শোক করার সময় নেই! সময়ের কষাঘাত বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে তাঁকে ; শোক ও রোদনকে পরিণত করতে হয় শক্তিতে। না, তিনি রোদন করতে আসেননি, এসেছেন বদ্ধ ইতিহাসের দুয়ার খুলে প্রিয় জন্মভূমিকে রাহুমুক্ত করতে; জাতির পিতার স্বপ্নের, মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ; ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই যা তাঁরই হাতে সমর্পিত। অতএব পিতা,মাতা, ভাই ও ভাতৃবঁধুদের স্মৃতিতে শোক করার সময় কই !
ইতিহাস সাক্ষ দেয়, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটিকে আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছিল; ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। সেই দুর্দিনে দেশের বাইরে অবস্থান করেও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন শেখ হাসিনা। অবিন্যস্থ দলকে সংগঠিত করা যেমন গুরু দায়িত্ব, তেমনি অসীম গুরুত্ববাহী কাজ ঘাতক ব্যষ্টিত শাসককূলের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করা, বিদ্ধস্থ বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলা এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে স্বমহীমায় পুন:প্রতিষ্ঠা করা।
বলা বাহুল্য সেদিনের সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ ছিলো না। মৃত্যুকে বারবার তুচ্ছজ্ঞান করেও শেখ হাসিনা তাঁর অভীষ্ঠ দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন ; ঘাতকের বারংবারের হুমকিÑ আক্রমনেও পিছিয়ে আসেন নি, পথভ্রষ্ঠ হননি; হলে, অধ:পতনের গহবর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ফিরে পাওয়া সহজ হতোনা ।
রাহুমক্তির পালা
এক মহাদুর্দিনে দিকভ্রান্ত স্বদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে জাতির জনকের হত্যাকান্ডের পর যে তমসা রাষ্ট্রকে গহীন কালোয় আচ্ছাদিত করে, সেই তমসা তাড়াতে প্রথম আলোর মশাল জ্বালেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকটÑসীমাবদ্ধতার পরেও, দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহুমুক্তির পালা। সব আবর্জনা দূর করতে নববর্ষের প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, নব প্রতিশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রুতির বাতাস বইতে দেখি তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রায়।
আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনার শাসনামলে মোড় ঘুড়ানো অর্জনের মৌলিক স্তরগুলিকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সংগ্রামে তাঁর সাফল্য। দ্বিতীয়ত, সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সফলতা। তৃতীয়ত, জাতির জনকের হত্যাকারী ও মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের আইনের হাতে সোপার্দ করা। এবং চতুর্থত, অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশকে প্রগতির সড়কে আনা।
বলা বাহুল্য, এই একেকটি স্তরের সাফল্য আনতে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছেন, কৌশলি হয়েছেন, সামালোচিতও হয়েছেন ; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পুনর্জাগরিত মঞ্চ গুড়িয়ে দিতে এবং জাতীয় স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত ইতিহাসের প্রতি দৃঢ়চিত্ত অবস্থান থেকে একটিবারের জন্যেও তিনি বিচ্যুত হননি। লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি ছিলেন অবিচল যদিও কিছু পথ ও পদ্ধতির সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।
বিলক্ষণ জানতেন তিনি, পথচ্যুত বাংলাদেশকে প্রার্থীত রাজণীতিধারায় ফিরিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে স্বমহিমায় পুন:প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই জয়বাংলার পুনরাভিযানের, জাতির জনকের হত্যাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানপন্থি ঘাতক যুদ্ধারাধীদের বিচারের । অতএব দেশে ফেরার প্রথম দিন থেকে লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল করেন নি তিনি। সে যাত্রাপথ, যতো কণ্টককীর্ণই হোক না কেন, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি বলা যাবে না একেবারে। প্রথমত সামরিক স্বৈরশাসনের আঘাতে জর্জরিত দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি, সংকটব্যর্থতা ও সাফল্যের সিড়ি বেয়ে সামনে পা বাড়ান। কিন্তু সবকিছুর ছাপিয়ে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবী ইতিহাস Ñ যা লুণ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ এর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। অতএব, ব্যক্তি বা পারিবারিক ট্রেজেডির বাইরে, জাতীয় ট্রেজেডি মুচনের কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করতে হয়েছে তাঁকে। এই বিচার কেবল জাতীয় কলংককেই মুছে দেয়নি, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র দৃঢ়চিত্ত হয়েছে,সামনে এগুবার সাহস পেয়েছে।
রাজনীতিতে তাঁর অধিষ্ঠান ঘটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যখন মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক শিরোমনি পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়,পরীক্ষিত স্বাধীনতা বিরোধীদের পরিকল্পিত ভাবে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর ক্ষমতায় বসেন আরেক জেনারেল, হুসেন মুহম্মদ এরশাদ, যিনি তার পূর্বসূরীর পথ ধরেই রাষ্ট্রকে মৌল ইতিহাসধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এই দুই জেনারেল পালাক্রমে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেন, পুনর্বাসন করেন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দান করেন। এ সময়, বিশেষত ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী গণআন্দোলনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের মনোজগতে এক নীরব বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, তারা জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস খুঁজতে চেষ্টা করে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সরব হয়।
কিন্তু ১৯৯১ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য রাষ্ট্রক্ষমতার আরোহকে ঠেকানো হয়, যা তাঁকে পিছিয়ে দেয়। আরও পাঁচ বছর পর, ১৯৯৬ সালে, প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে ঝড়ের নদীতে নৌকার পাল ধরেন তিনি। দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে। চারদিকে তখন শকুনীদের থাবা। প্রশাসন সহ রাষ্ট্রজীবনের সকল স্তরে বসা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা যে করেই হোক নতুন সরকারকে ব্যর্থ করতে বদ্ধ পরিকর। সে এক সুবিশাল চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনার।
এরই মধ্যে, অনেকটা আকস্মিক ভাবে, জাতীয় সংবাদ সংস্থা অর্থাৎ বাসস-এর হাল ধরতে হলো আমাকে, শুনেছি তাঁরই নির্বাচনে। সংস্থাটিতে তখন পাহাড় সমান সংকট। প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রথম দেখা করতে গেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি স্বাগত জানালেন, মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি সংকট বৃত্তান্ত শুনলেন এবং সংস্থায় বাংলা সার্ভিস প্রবর্তণসহ বাসসকে আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিতে সব পদক্ষেপ নিতে বললেন। তাঁরই প্রতিশ্রুতির ফলে জাতীয় সংবাদ সংস্থার নবগঠিত বাংলা সার্ভিস গতি লাভ করল,যুগপ্রাচীন টেলিপ্রিণ্টার পরিবর্তন হয়ে কম্পিউটার বসল। বহুবিধ বিদেশি বার্তা ও ফিচার সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা গেল। শেখ হাসিনা অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখলেন।
কিন্তু সংস্থায় আদর্শিক প্রতিপক্ষরা ছিলেন সংগঠিত এবং শক্ত যোগাযোগ সম্পন্ন। অতএব তারা একের পর এক আঘাত হানলেন। সে আঘাত ঠেকাতে শক্ত ভূমিকা নেওয়া ছাড়া উপায় রইলনা আমার। এরই মধ্যে আমার নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে মামলা করে বসলেন তারা। জাঁদরেল ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদ তাঁদের উকিল। সরকার বিরোধী পত্রিকাগুলি সে খবর ছেপে তাদের উৎসাহিত করল। রীটে দাবি করা হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুড়ো প্রবীনদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে নিয়োগ দিয়ে আইন ও রীতি ভেঙ্গেছেন। আগে কখনোই আমি মামলামোকাদ্দমায় পড়িনি। সে এক বড় বিরম্বনা ব্যক্তি জীবনের। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অতএব ছুটলাম শ্রদ্ধেয় ব্যারিষ্টার আমীর উল ইসলাম ও ব্যারিষ্টার তানীয়া আমীরের কাছে। গিয়ে শুনলাম, নেত্রী আগেই কথা বলেছেন যাতে আমার পক্ষে মামলাটি তাঁরা হাতে নেন। সেই মামলা চলেছে সাত বছর।
বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচনে সুপরিকল্পিত ভাবে হারানো হল আওয়ামী লীগকে। আনা হল বিএনপি জামাতের জোটকে। নির্বাচনে হেরে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী হলেন। সরকারের সিদ্ধান্তে বছরের পর বছর আমার বেতনভাতা বন্ধ থাকল। চাকুরিচ্যুতও করা হল। কিন্তু সংস্থার আইনে আমার নিয়োগটি মোটেও অবৈধ ছিলোনা বলে শেষ পর্যন্ত মাননীয় হাই কোর্ট এবং পরবর্তিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমি বিজয়ী হলাম। কিন্তু আর ফেরা হলো না আমার কর্মস্থলে ।
যুদ্ধাপরাধ বিচার ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে বাংলাদেশের মাটিতে যে নির্বিচার নৃসংশতা ঘটে তা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তিকালে বিশে^র পঞ্চম বৃহতম গণহত্যা। এর শিকার হয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালি। নির্যাতিত হয়েছে কয়েক লক্ষ নারী। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নির্বিচারে জ¦ালানো হয়েছে ঘরবাড়ি। ফলে ১ কোটি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ফেলে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, কাটাতে হয়েছে প্রায় এক বছরের শরণার্থী জীবন।
সে কারণে ন্যায় বিচারের স্বার্থে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় ঘাতক অনুচরদের বিচারের প্রশ্নটি ছিল মানব সভ্যতার দাবি, একই সঙ্গে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি। কিন্তু ১৯৭১ পরবর্তি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সেই খুনি ও ধর্ষকদের আইনের হাতে সোপার্দ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী চিহিৃত করে, তারা সহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি দেশে ফিরে যায়। এদিকে আইন করে বন্ধ করা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার। দালাল আইনের আওতায় বিচারাধীন, এমন কি দন্ডিত অপরাধীদেরও জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই থেকে দেশে চলতে থাকে বিচারহীনতার এক সংস্কৃতি। একদিকে নির্বিচার গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের কোনো বিচার হয়না, অন্যদিকে বিচার বন্ধ থাকে জাতির পিতার হত্যাকারীদের। অথচ অপরাধের বিচার না হলে মানুষের অপরাধবোধ জেগে ওঠে, সমাজ কুলষিত হয়, সভ্যতা বিপন্ন হয়।
কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্ব বিচারহীনতার অমানবিক সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলে। তিন দশকেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করা ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মানদন্ডে এক বড় দৃষ্টান্ত, যা জাতিকে দায়মুক্তি দিয়েছে, কলংক থেকে মুক্তি দিয়েছে। শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী নেতৃত্বে জাতির পিতার ঘৃন্য ঘাতকেরা কৃত অপরাধের দায়ে দন্ডিত হয়েছে, যা সমকালীন বাস্তবতায় সাধারণ কাজ ছিলো না। অন্যদিকে, দেশীয় আইনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি তিনি কেবল শুরু করেন নি, দেশিবিদেশি চাঁপ ও ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত জাল উপেক্ষা করে এগিয়ে নিয়েছেন সাহস ও বিচক্ষণতায়। এই দুটি কাজ, যা অভাবিত ভাবা হতো একসময়, বাঙালি জাতিকে দৃঢ়চিত্ত করেছে, বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে ; একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার লাখো শহীদ ও লাখো বীর সৈনিকদের আত্মাকে সম্মানীত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর একটি বড় মনস্থাত্তিক সংকট সমাজকে পর্যুদস্থ করতে থাকে। সে সংকট ছিল অসহায়ত্বের, কিছু করতে না পারার। ১৯৮০ দশকের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শিক চেতনা পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনস্তাত্তিক পূণ:জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। দীর্ঘকালীন বিচারহীনতা, সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পালাক্রমিক আধিপত্য এই পূণ:জাগরণকে বেগবান করে। ইতিহাস যেন নিজের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তার সত্যকে আবিস্কার করে। এরই ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবি সোচ্চার হতে থাকে। মোড় ঘুরানো এই পুনর্জাগরণে মূখ্য রাজনৈতিক ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধুর কণ্যা। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সুষ্পষ্ট অঙ্গিকার আসে । লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি দিয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনি রায়, ঠিক একই ভাবে যুদ্ধাপরাধের যুগান্তকরি বিচার শুরু করার পেছনে ভিত্তি জুগিয়েছে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের রায় Ñ যা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের শেষ প্রান্তে। সে নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের ভোটদাতারা বিপুলভাবে রায় প্রদান করে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠানের পক্ষে।
নির্বাচনে বিপূলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযুক্তদের বিচারের জন্য গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনারের আওতায় আসে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ Ñ যা সারাবিশে^ই আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর, বিশেষ করে মূল অভিযুক্তরা যখন রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক ভাবে সবল ও শক্ত যোগাযোগ সম্পন্ন, তখন তাদের বিরুদ্ধে এমন একটি বিচারিক উদ্যোগ, বলা বাহুল্য, সাধারণ কোনো উদ্যোগ ছিলোনা। বরং তা ছিল বহুলাংশেই এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ। অনস্বীকার্য, শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াটি প্রবল জনসমর্থনে সিক্ত হলেও এর বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশে সমালোচনার সৃষ্টি করা হয়। অভিযুক্তরা বিপূল অর্থ বিনিয়োগ করে ‘লবিষ্ট’ নিয়োগ করে। ফলে নানা দেশে বিচার প্রক্রিয়াটি সমালোচনার মুখে পড়ে। পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দেশটি সরকারি ভাবেই কেবল বিচারের বিরোধীতা করেনা, তাদের ন্যাশনাল এসেম্লিতে, সকল আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভেঙ্গে, বিচারের বিরুদ্ধে প্রস্থাব গ্রহন করা হয়। অন্যদিকে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক সমর্থক দলগুলি সহিংস পথ অবলম্বন করে। কিন্তু শেখ হাসিনার সুদৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অটল থাকে। ফলে সব চাঁপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সামনে এগিয়ে যায়। অনেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে কী অসামান্য সাহসী ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন জাতির পিতার এই সাহসী কণ্যা !
১৯৯২ সালে রাজাকার শিরোমনি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে জামাতের আমীর ঘোষণা করা হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতকÑদালাল নির্মূল কমিটি। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়, তার মূল রাজনৈতিক শক্তি ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁরই প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সমন্বয় কমিটিতে আওয়ামী লীগ থেকে যুক্ত হন জনাব আব্দুর রাজ্জাক এবং জাসদ থেকে কাজী আরেফ আহমেদ। খালেদা জিয়ার শাসনামলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি বসে ঐতিহাসিক গণআদালত। প্রতীকি সে আদালতে লাখো মানুষের সমর্থণে গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদন্ডতুল্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার সরকার নির্মম দমনপীড়ন শুরু করে, ২৪ জন বরেণ্য জাতীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রজু করে। সে পরিস্থিতিতেও দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা।
১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে তিনি যে বক্তব্য রাখেন, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, “---- গণআদালত যে রায় দিয়েছে তাতে তারা কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি, মাননীয় স্পীকার। যেহেতু তারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি সেহেতু নিশ্চয়ই তাদেরকে বেআইনি বলার কোনো অধিকার নেই, কোনো অবকাশ নেই। এই যুদ্ধাপরাধীর (গোলাম আযমের) অপরাধগুলি (গণআদালতের রায়ের কাগজি দেখিয়ে) লিপিবদ্ধ আছে এবং এই সকল অপরাধে যিনি অপরাধী তার শাস্তি মৃত্যুদন্ডতুল্য।--- তাই আমার আবেদন মাননীয় স্পীকার, এখনো সময় আছে দলমত নির্বিশেষে সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে আসুন,যেভাবে একমত হয়ে আমরা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাস করেছি,আসুন সেভাবে কাজ করি। যারা স্বজন হারিয়েছেন,স্বজন হারানোর ব্যাথায় যাদের হৃদয় এখনো ব্যথিত, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেই।”
গণআদালতের রায়কে সমর্থন জানিয়ে তিনি আরও বলেন,--“এই মহান সংসদের অধিকার রয়েছে। জাতি সেই অধিকার দিয়েছে। এই সংসদ সার্বভৌম সংসদ। সেই লক্ষ্যে Ñ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ, যুদ্ধ ও গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সাধন,বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের সাথে জড়িত থেকে বাংলাদেশের বিরোধীতা,বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্বেও ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জনগনের যে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আন্তর্জাতিক ক্রাইমস এ্যক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তার বিরুদ্ধে আনিত অপরাধ সমূহ বিচারের জন্য, আইনগত পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে এই সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে জনগণের ঐ মতামত প্রতিফলনকারী গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে জারীকৃত অসম্মানজনক মামলা দায়ের করার জন্য দু:খ প্রকাশ করে ঐ মামলা প্রত্যাহার করার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।”
জাতীয় সংসদে সেদিন দীর্ঘ বিতর্ক চলে গণআদালতের রায় নিয়ে। খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্য হয়ে ২৯ জুল ১৯৯২ বিরোধী দলের সঙ্গে ৪Ñদফার চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে চুক্তিতে গোলাম আযমের বিচার ও গণআদালতের উদ্য্যোক্তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের কথা ছিল। কিন্তু সে চুক্তির বাস্তবায়ন করেনি সেদিনের সরকার!
মোটকথা, ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ এর ঘাতকদের বিচারের দাবি ছিল সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম,মনুষত্বের সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি ও তাকে সুরক্ষা দেওয়ার সংগ্রাম, যাকে সাহস ও দৃঢ়তায় সম্পন্ন করার বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা।
স্মরণযোগ্য, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে ‘ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল’ ও ‘টোকিও ট্রায়াল’ বসে, তারও মূল দাবি ছিল সভ্যতার বোধ সৃষ্টি করা। সেই বিচারে মিত্র পক্ষের প্রধান আইনজীবী জাস্টিস জ্যাকসনের ভাষ্য ছিল এ রকম: ‘মানব জাতিকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রয়োজন। এই বিচার না হলে সমাজে সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা।’ অন্যদিকে গণহত্যার মতো সুপরিকল্পিত ব্যাপক হত্যাকান্ডগুলির বিচার না করা গেলে তা আবারও ফিরে আসে । যেমন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ইউরোপের মাটিতে নাজি বাহিনীর বর্বরতার নৃসংসতা মাত্র কয়েক যুগের মাথায় বাংলাদেশ, রুয়ান্ডা,বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও কম্বোডিয়াসহ নানা দেশে ফিরে এসেছে।
অনস্বীকার্য, সব দেশেই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবতার লড়াই, সভ্যতার লড়াই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও আছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই, ইতিহাসের লড়াই এবং বাঙালি জীবনের আদর্শিক ভিত্তির লড়াই ও ভবিষ্যত। সে লড়াইকে এগিয়ে নিয়েছে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ।
উপসংহার
খুব বেশি দেখা বা কথা বলার সুযোগ হয়নি আমার শেখ হাসিনার সঙ্গে । লেখালেখির নিভৃত জীবনযাপনেই স্বাছন্দ আমার। তবে সাংবাদিকতার সুবাদে বার কয়েক দেখা হয়েছে । যতোবার হয়েছে, ততবারই দেখেছি তাঁকে সাবলিল, বঙ্গবন্ধুর পাওয়া মেজাজ ও অন্তরঙ্গতায় ভরা খাটি বাঙালি হিসেবে। এক দুবার নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের দিনে অভ্যাগতদের সঙ্গে প্রাণখোলা কথাবার্তা বলতে দেখেছি তাঁকে। এমনই খোলামেলা যে অনেকেই ভয় পেয়ে যান, বলতে থাকেন, এতোটা খোলামেলা হতে যান কেন তিনি ! কিন্তু শেখ হাসিনা কোনোকিছু লুকোবার চেষ্টা করেন Ñ এমনটা ভাবা ঠিক নয়। যা তিনি ভাবেন Ñ তাকে রাখঢাকের প্রয়োজন বোধ করেন না। এতেই তাঁর সাতন্ত্রতা।
শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি দেখিনে কেবল। প্রধানমন্ত্রী হন অনেকেই, হবেনও। তাঁকে দেখি আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্র জনকের বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন হিসেবে, যিঁনি রাষ্ট্রকে তার ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার মহাসমরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৫ এর রক্তপাতের পর যে ভয়ংকর স্বদেশ, জেগে ওঠা যে ‘নব্য পাকিস্তান’(!), তারই বিপরীতে বাঙালির রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহসী ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব তারই সর্বাধিনায়কের নাম শেখ হাসিনা।
আমার বিশ্বাস, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি। সে যুদ্ধ কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা ভয়ংকর এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ Ñ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কাজেই ভয়ংকর ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাঁকে । ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সুখ ও সাচ্ছন্দ পরিত্যাগ করতে হয়েছে । দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রভাবশালী দেশিবিদেশি মহলের প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা । সেই বিপদসঙ্কূল পথে সামনে এগুবার যে সাহস, এই যে দৃঢ়তা Ñ তার সবটাই দেখাতে পেরেছেন শেখ হাসিনা।
সকলেই জানি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে সরকরের রাজনৈতিক বিরোধীদের স্বাধীন ও উন্মুক্ত কার্যক্রম জরুরি। এ ছাড়া রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, মানবিক ও আধুনিক হয়না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এই যে, পাঁচ দশক পরেও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিরোধীরা আজও সর্বাংশে স্বক্রিয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের আবরণে এরা রাষ্ট্রের ইতিহাস ও মৌলিক চেতনার প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের আবির্ভূত করে ; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন যুদ্ধ চাঁপিয়ে পুরনো প্রভুর জয়গান করে! কাজেই যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত তাকে সুরক্ষা দিতে হবে বৈকি।
অনেক অর্জনের পরেও বাংলাদেশ আজ এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি। অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধ পন্থিদের দীর্ঘ পালাক্রমিক শাসনের পরেও আজও কেন স্বক্রিয় Ñতা ভেবে দেখার দাবি রাখে বৈকি। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। দীর্ঘস্থায়ি সমরে জেতার প্রস্তুতি প্রয়োজন ; প্রয়োজন আদর্শিক যোদ্ধা তৈরির কৃতিত্ব। রাজনীতি কেবলই শ্লোগান সর্বস্য হয়ে উঠুক Ñ তা কাম্য হতে পারেনা। এই প্রক্রিয়া সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম বটে, কিন্তু বৃহৎ আক্রমন প্রতিহত করার জন্যে সামর্থ হারায়। ভুলে গেলে চলবেনা, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্বার প্রতিপক্ষরা প্রাথমিক ভাবে পরাস্থ হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ি যুদ্ধে লিপ্ত। অতএব রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই ; চাই বাঙালি জীবনের নবজাগৃতি।
১৯৮১ সাল থেকে দীর্ঘ পথযাত্রা শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের চেহারা আজ সুষ্পষ্ট ভাবেই আলাদা। সে আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো সুবৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাফল্য অর্জিত হয়েছে দেশে , যা উদভাসিত করেছে জাতীয় আত্মশক্তির, আত্মমর্যাদার। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের সিঁড়ি পেয়েছে। শেখ হাসিনার পালাক্রমিক রাষ্ট্রশাসনে রাষ্ট্র আজ উন্নয়ন ও প্রগতির মহাসড়কের যাত্রি। বলা বাহুল্য, এরপরেও বঙ্গবন্ধু কণ্যার কাছে জনপ্রত্যাশা অপরিসীম । প্রত্যাশার সীমা এতোটাই যে সকলেই যেন ভুলতে বসেন কী ভয়ংকর কূট পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মকে ব্যর্থ করা চেষ্টা হয়েছিল ! কিন্তু শেখ হাসিনা ব্যর্থ হননি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশকে তিনি নতুন জীবন দান করেছেন। প্রবল প্রতিকূলতা মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত ধারাকে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন। এ এক অসামান্য কৃতিত্ব তাঁর।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক,মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা