বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে আরও আট ধাপ পেছাল বাংলাদেশ। দেশের অবস্থান এখন ৮৪তম। সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ৬।
২০২১ সালের ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম। ২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম। ২০১৯ সালে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮তম এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬তম।
বৃহস্পতিবার বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (জিএইচআই) ২০২২ প্রকাশিত হয়। কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে যৌথভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জিএইচআইয়ের ওয়েবসাইটে সূচকটি প্রকাশিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে এই ক্ষুধার এ সূচকটি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪টি দেশে গুরুতর বা উদ্বেগজনক মাত্রায় ক্ষুধার পরিস্থিতি চলছে। সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বেলারুশ, বসনিয়া, চিলি, চীনসহ ১৭টি দেশ। এসব দেশের প্রত্যেকের স্কোর ৫-এর নিচে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে ইয়েমেন, স্কোর ৪৫।
সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১০৭তম, স্কোর ২৭ দশমিক ৫। ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ১০১তম। ২০২০ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৯৪তম। এবারের সূচকে ৯৯তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান, স্কোর ২৬ দশমিক ১। ২০২১ ও ২০২০ সালে পাকিস্তান ছিল ৯২তম ও ৮৮তম অবস্থানে। ২০২২ সালের সূচকে বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী নেপালের অবস্থান 8১তম, স্কোর ১৯ দশমিক ১। আর মিয়ানমারের অবস্থান ৭১তম, স্কোর ১৫ দশমিক ৬।
ক্ষুধার বৈশ্বিক এ সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক সংকটে থাকা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত কয়েকটি দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। যেমন, অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার অবস্থান এ সূচকে ৬৪তম। প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকা ইরাক, লেবানন, ঘানা ও সেনেগালের অবস্থানও বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। এমনকি সাত মাস ধরে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা ইউক্রেনও বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে, ৩৬তম অবস্থানে।
ক্ষুধার এ সূচক নিয়ে কথা হয় গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে। তার মতে, বিশ্বের কিছু দেশ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে তারা সামগ্রিকভাবে উন্নত। তেমনই একটি দেশ শ্রীলঙ্কা। এ দেশটি সব সময়ই শিক্ষার হার, আয়, জীবনযাত্রার মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে।
জিএইচআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষিপণ্য উৎপাদনে রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম দুটি বড় দেশ। বিশ্বের ১২ শতাংশ কৃষিপণ্য আসে এ দুই দেশ থেকেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের শস্যবাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ ধ্বংস করেছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এই দুই দেশ থেকে গম আমদানি করে বাংলাদেশ, মিসর, ইরান, তুরস্কসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ। যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় বিকল্প খুঁজে পেতে এসব দেশ বিপাকে আছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি, বন্যা ও করোনা ধাক্কায় বাংলাদেশ ক্ষুধা সূচকে একটু পিছিয়ে পড়েছে। এটি হতেই পারে। ইউক্রেনে যুদ্ধাবস্থা থাকলেও তাদের খাদ্যের ভান্ডার বিশাল। যুদ্ধের মধ্যেও ইউক্রেন খাদ্য রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, ‘আমরাও ইউক্রেন থেকে আমদানি করতে পারতাম। তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।’
জিএইচআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালে ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৪, যা ক্ষুধার ‘গুরুতর’ মাত্রাকে নির্দেশ করে। ২০০৭ সালে স্কোরে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়, স্কোর দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৩। ২০১৪ সালের স্কোরে বাংলাদেশ আরও উন্নতি করে, স্কোর হয় ২৬ দশমিক ৩। তখন গুরুতর দেশের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। ২০২১ সালে এ স্কোর সহনীয় পর্যায়ে বিবেচিত হয়ে ১৯ দশমিক ১ পয়েন্টে দাঁড়ায়। এই স্কোর চলতি বছরে কিছুটা বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক ৬।
সারা বিশ্বের ৮২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে উল্লেখ করে জিএইচআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সংখ্যক মানুষের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার নেই। এর মধ্যে লাখ লাখ শিশু আছে যারা খর্বাকৃতির বা কম ওজনের কারণে পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যায়। এই সূচকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটির দিকে যাচ্ছে। তবে এর বাইরেও আরও ৩১০ কোটি মানুষ আছেন, যারা পুষ্টিকর খাবার দৈনিক খেতে পারেন না।
ক্ষুধার এ পরিস্থিতি মূলত তিন কারণে- জলবায়ু পরিবর্তন, সহিংসতা সংঘাত এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালের অর্থনৈতিক মন্দা। এই তিন কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এই জটিল সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেনে যুদ্বাবস্থা। যুদ্ধের কারণে খাদ্য, সার এবং জ্বালানির বাজারে ব্যাঘাত ঘটছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সূচকে কোনো দেশের স্কোর শূন্য হলে, সেখানে ক্ষুধা নেই। আর স্কোর ১০০ হওয়া মানে সেখানে ক্ষুধার মাত্রা সর্বোচ্চ। অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
জিএইচআইয়ের প্রতিবেদনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টরেরো বলেন, ‘সারা বিশ্বের মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট খাবার আছে। তবে ক্ষুধার্তদের কাছে সেসব খাবার পৌঁছায় না।’
ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি আরও বাড়াতে করণীয় কী জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে খাদ্য উৎপাদনে যেটুকু কমতি আছে তার বিপরীতে আমদানি সেভাবে হয়নি। খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি করা যেতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তায় সরকার আরও নজর দিলে ক্ষুধা সূচকে দেশের অবস্থান ভালো হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা